Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

বগুড়া জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি:

 

বগুড়া জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি:

 

সাহিত্যএক অমল চিৎপ্রকর্ষ ভেতর-বাইরে যার সমপর্যায়ী আঘ্রাণ। এক অনিত্য অবস্থা থেকেনিত্যকালের হয়ে ওঠা সাহিত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। চিত্তবৃত্তির এমনবহিঃপ্রকাশ অন্য কোনো শিল্পে দেখা যায় না। সাহিত্যের কাজ সম্পর্কেরবীন্দ্রনাথের উক্তি প্রণিধানযোগ্য-‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের,ভাবের জিনিসকেভাষায়,নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়াতোলাই সাহিত্যের কাজ।’যুগে যুগে মানবের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বিরাহ-আনন্দ, ব্যথা-বেদনা ও তার অনন্ত আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্যবিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান কবি-সাহিত্যকগণ। আকার-প্রকারে, ভাবে-ভাষায়, সুরে-ছন্দে মিলেই তার বেঁচে থাকা। সাহিত্যের বিশাল ভুবনের অংশীদারিত্ব নিতেগিয়ে কেউ সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেন, কেউ ব্যর্থতার গ্লানি বুকে বয়ে বেড়ান।বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের যে ঐতিহ্যের কথা আমরা বলে থাকি, সেখানেও রয়েগেছে সেই বহিঃপ্রকাশের ইঙ্গিত।

বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’থেকে শুরু করে বর্তমান কালঅবধি সাহিত্যেরবিস্তৃত ভূ-ভাগ জুড়ে প্রতিনিয়তই যে-সৃষ্টির উন্মাদনা লক্ষ্য করে আসছি, তাকেএকটি ধারাবাহিক সৃষ্টির ইতিহাস ছাড়া অন্য কোনোভাবে অভিহিত করা যায় না।সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা অর্থাৎগল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এগুলোযে-বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের অন্তহীন প্রচেষ্টার এক একটি সাক্ষ্য, একএকটি অনবদ্য সৃষ্টি, তা ভুললে চলে না। একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজঅর্থাৎতার সমগ্রকে জানতে হলে তার সাহিত্যের ইতিহাসকে অনিবার্যভাবে পাঠকেরসামনে তুলে ধরতে হয়।

জেলা কালচারাল অফিসার

মোবাইলঃ

০১৭১৪-৬২৩২৩৬

 

জেলা সংগঠক

শিশু একাডেমি, বগুড়া।

ফোনঃ ০৫১-৬৬১২৪

জনাব এ এইচ আযম খান

(সভাপতি) বগুড়া থিয়েটার, বগুড়া।

মোবাইলঃ ০১৭১৫-৭১৬৫৬২

 

জনাব মো: তৌফিক হাসান ময়না

(সম্পাদক) বগুড়া থিয়েটার, বগুড়া।

মোবাইল : ০১৭১১-৮৬৯৭৪৯

২. বগুড়াঃ ইতিহাসের প্রেক্ষিত:

বগরা খাঁরনামানুসারে বগুড়া জেলা উত্তরবঙ্গের একটি প্রচীন জনপদ। করতোয়া নদীরতীরসংলগ্ন যে-ভূমিটি ছিল হিন্দু আমলের গৌড়েশ্বরের রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন, হযরত শাহ্ সুলতান বলখী মাহীসাওয়ারের তীর্থভূমি আজাকের মহাস্থান, একদা অনেকমনীষী, পর্যটক, পীর-ফকির-আউলিয়ার পদপাতে ধন্য হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট জনপদ।ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বগুড়া। হিন্দু আমল, সুলতানী আমল, নবাবী আমল, বৃটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল পেরিয়ে এই বাংলাদেশ পর্যন্ত বগুড়ারইতিহাস বৈচিত্র্যের ইতিহাস, বহু শাসকের উত্থান-পতনের ইতিহাস, অত্যাচার, শোষণের ইতিহাস, বিদ্রোহ-আন্দোলনের ইতিহাস,বহুরক্ত-ত্যাগ-তিতিক্ষা-যুদ্ধ-স্বাধীনতার ইতিহাস।সব মিলিয়ে বগুড়া জেলারঐতিহাসিক ভূমিকা অনিবার্যভাবে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়েদাঁড়ায়। এই বিশাল ইতিহাসের পরিধিতে করতোয়াস্রোত বগুড়ার ভূমিতে জন্মগ্রহণকরেছেন,প্রোথিতযশা অনেক কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের রচনাকর্ম একদিকে যেমন একইজেলার গৌরবসময় ভূমিকাকে উজ্জ্বল করেছে,তেমনি এদেশের সাহিত্যাঙ্গনকে করেছেগতিশীল ও সমৃদ্ধ। শুধু তাই নয়,বগুড়ার প্রাচীনকালের কবি-সাহিত্যকদেররচনাবলীর দ্বারা যেমন আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বারবার ফিরে পাই,তেমনিআধুনিককালের কবি-সাহিত্যকদের রচনাবলী দেশের তথা সাহিত্যের বিশ্ব-ইতিহাসঅনুসন্ধানে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অতীত ও বর্তমানের এই মহামিলনের মধ্যেসেতু রচনা করতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের সকল ইতিহাস একদিনবিস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন-একথা শুধুমুখে বললেই হবে না, সঠিক ইতিহাস রচনার মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বিকৃত ইতিহাসের মধ্যে নয়। আমি মনে করি, জেলার ইতিহাস লেখার পাশাপাশি আলাদাগ্রন্থে বগুড়া জেলার কবি-সাহিত্যেকদের জীবন ও তাঁদের রচনাকর্মের সঠিকইতিহাস তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন, প্রয়োজন আমাদের মূল্যায়নের। আজ বগুড়াবাসীরঅনেকেই বগুড়ার কবি-সাহিত্যকদের নাম জানেন না, চেনন না। জানেন না বগুড়ায়জন্মগ্রহণ করে চাকরিসূত্রে বা অন্যান্য কারণে জেলার বাইরে অবস্থান করেওসাহিত্যক্ষেত্রে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন এমন ব্যক্তির নাম এই জানাটা অত্যন্তজরুরি। অন্তত ভবিষ্যৎপ্রজন্মের জন্য। আমরা আশা করবো,ভবিষ্যতে এ ধরনেরদায়িত্ববান কেউ এগিয়ে আসবেন। ভাবতে অবাক লাগে প্রভাস সেনের বগুড়ার ইতিহাস, কে. এম. মেছেরের ‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’ আমানউল্লাহ খানের ‘আজকের বগুড়া’ শামসুদ্দীন তরফদারের ‘দুই শতাব্দীর বুকে’ এবং এ ধরনের লেখা বইগুলো শুধুপুনমুদ্রণের অভাবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কে. এম. মেছেরের‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’ বইটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে। প্রভাস সেনের বইটিউডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক সাহেব নিজের হেফাজতে রেখেছেনহারিয়ে যাবার ভয়ে। প্রভাস সেনের বইটি [প্রায়াত সাংবাদিক দুর্গাদাসমুখার্জীর তত্ত্বাবধানে] দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পেলেও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুপাঠ গ্রন্থটির সন্ধান জানেন কি-না আমার জানা নেই। এই যদি হয় বগুড়ার ইতিহাসগ্রন্থের অবস্থা তবে আমরা কীভাবে খুঁজে পাবো আমাদের ঐতিহ্য-ইতিহাস?

বগুড়ার সাহিত্যঃ হিন্দু আমল:

১১৩৪খৃস্টাব্দ থেকে ১১৮৭ খৃস্টাব্দের মধ্যে বগুড়া দু’জন কবির সাক্ষাৎপাই।গৌড়ের রাজা মদন পালদেবের সময়ে কবি সন্ধ্যাকার নন্দীর জন্মস্থান উল্লেখকরেছেন মহাস্থান সন্নিকটবর্তী পৌন্ড্রবর্ধনপুর। তাঁর পিতা কায়স্তদের অগ্রণীছিলেন। পিতার নাম প্রজাপতি নন্দী বলে উল্লেখ করেছেন ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্রমজুমদার। পিতামহের নাম পিনাক নন্দী। সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যগ্রন্থের নাম‘রামচরিয়তম’। রামচন্দ্রের সীতাউদ্ধার কাহিনী গ্রন্থটির মূল বিষয়।ঐতিহাসিকগণ তাঁর কাব্যের ভাষাকে মার্জিত ও সুরুচিকর বলে অভিহিত করেছেন।অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্যর জন্মস্থান শিবগঞ্জ থানার বিহার গ্রামে। তাঁরকাব্যগ্রন্থের নাম ‘হারলতা’। রমেশ চন্দ্র মজুমদার ‘পিতৃদয়িতা’নামে আরেকখানিগ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি রাজা বল্লাল সেনের সাহিত্যগুরু ছিলেনবলে ঐতিহাসিকগণ মত প্রকাশ করেন।

বগুড়ার সাহিত্যঃ সুলতানী আমল:

১৪০৮সালের দিকে উদয়নাচার্য ভাদুড়ী নামে একজন গ্রন্থকারের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরজন্মস্থান কাহালু থানার নিশিন্দ্রা গ্রামে। কারো কারো মতে, নন্দীগ্রামথানার নিশিন্দারা গ্রামে তাঁর জন্ম। উদয়নাচার্যের গ্রন্থের নাম‘কুসুমাঞ্জলি’। কাশীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বগুড়ার সাহিত্যঃ নবাবী আমল:

এই আমলেবগুড়া জেলায় বেশকিছু কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। ১৫৭৬ খৃস্টাব্দের সময়থেকে তাঁদের পদচারণা। সেই সময়ে যাঁদের নাম পাই তাঁরা হলেন-গদাধরভট্টাচার্য, রামনারায়ণ ভট্টাচার্য, নিত্যানন্দ আচার্য, কবি বল্লভ এবংজীবনকৃষ্ণ চৈত্র। গদাধর ভট্টাচার্যের নাম প্রসঙ্গে বগুড়ার দুই ঐতিহাসিক দুইধরনের নামোল্লেখ করেছেন। প্রভাস সেনের গ্রন্থে তাঁর নাম গঙ্গাধরভট্টাচার্য কিন্তু কে. এম. মেছেরের গ্রন্থে গদাধর ভট্টাচার্য বলা হয়েছে।বগুড়া জেলার লক্ষীচাপড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর দুই গ্রন্থের নাম‘ব্রহ্মনির্ণয়’ ও ‘গদাধরী টীকা’। আদমদীঘি থানার ‘তালসন’ গ্রামে রামনারায়ণভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। ‘কৃতভাষ্য’ তাঁর রচনাকর্ম। কবি বল্বভের জন্মমহাস্থানের কাছে আড়োয়া গ্রামে। পিতার নাম রাজবল্লভ, মাতার নাম বৈষ্ণবী।‘রসকদম্ব’ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় তিনিএই কাব্যটি রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থটি এত দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, কবিবল্লভ ‘রসকদম্ব’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর গ্রন্থটি শ্রীকৃষ্ণ এবংগোপিকাদের শৃঙ্গার রসে পরিপূর্ণ। কবি নিত্যানন্দ আচার্য অদ্ভুতাচার্য নামেপরিচিত। তিনি আদমদীঘি থানার কুন্ডুগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের কবিদেরমধ্যে সবেচেয়ে খ্যাতি অর্জন করেন মহাস্থানের লাহিড়ীপাড়া গ্রামের কবিজীবনকৃষ্ণ মৈত্র। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মনসা মঙ্গলের কবি হিসেবেপরিচিত। জীবনকৃষ্ণ মৈত্রের কাব্যের নাম ‘পদ্মপূরাণ’। এতে চাঁদ সওদাগর, মনসা, বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কবি তাঁর বংশপরিচয় দিয়েছেনএভাবে-‘শ্রী বংশীবদন মৈত্র নাম মহাশয়,চৌধুরী অনন্তরায় তাহার তনয়/অনন্তনন্দন কবি শ্রী মৈত্র জীবন/লাহিড়ীপাড়াতে বাস ‘বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ’। তিনি‘পাগলা জীবন’নামে পরিচিত ছিলেন। নিজস্ব কাব্যপ্রতিভার দ্বারা জীবন মৈত্রসাহিত্যের ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। সে গৌরবের অংশীদার বগুড়াবাসীও।

বগুড়ার সাহিত্যঃ বৃটিশ আমল-মধ্যভাগ:

মূলত এইআমল থেকেই বগুড়ার সাহিতাঙ্গনে কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণার ব্যাপকতা বৃদ্ধিপায়। বৃটিশ আমলের মধ্যভাগ এবং শেষভাগ অর্থাৎ১৯৪৮ খৃস্টাব্দের পরবর্তী সময়পর্যন্ত যে সমস্ত কবি-লেখকরা নিজেদের রচনাকর্মের দ্বারা খ্যাতি অর্জন করেনতাঁদের মধ্যে মুসলিম লেখকদের অবদানও কম ছিল না। বৃটিশ আমলের শেষ পর্যায়েরযাঁরা সাহিত্যক্ষেত্রে প্রসারিত করতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশ আমলেও তাঁদেরখ্যাতি একেবারে ম্লান হয়নি। বৃটিশআমলের মধ্যপর্যায় থেকে যাঁরা সাহিত্য রচনাশুরু করেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন-হরগোপাল দাসকুন্ডু, প্রাণগোবিন্দ দেব, প্রভাসচন্দ্র সেন, দেববর্শন বিএল, সারদানাথ খাঁবিএল, মুনশী হামেদ আলী শহরউল্লা, কাজী কলিমুদ্দিন, সৈয়দ বাহার উদ্দিন, কোববাদ হোসেন, ডাঃ কহরউল্লা। হরগোপাল দাস কুন্ডুর জন্মস্থান শেরপুর। তিনি‘ইতিহাস বগুড়া’নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রভাসচন্দ্র সেন মূলতঐতিহাসিক। বগুড়া জেলার প্রথম ইতিহাস লেখক হিসেবে তিনি সর্বজন পরিচিত। তিনি‘বগুড়ার ইতিহাস’নামে যে-গ্রন্থটি রচনা করেছেন তা বগুড়ার পূর্বাপর ইতিহাসরচনার ক্ষেত্রে অবদান হিসেবে স্বীকৃত। তিনি কাহালু থানার মহেশপুর গ্রামেজন্মগ্রহণ করেন। ‘বরেন্দ্র কাহিনী কৃষ্ণচরিত’ নামেও তাঁর গ্রন্থ আছে।সারদানাথ খাঁ ‘অশোক কাব্য’ নামে অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি কাব্য রচনা করেন।‘সতী বিমলা’ নামে তিনি একটি উপন্যাসও রচনা করেন। কাহালু থানার নারহট্টনিবাসী মুনশী হামেদ আলী ‘মুসলিম কর্মবীর চরিতমালা’ ‘মহসীনচরিত’ লিখে খ্যাতিঅর্জন করেন। তাঁর গদ্যের ভাষা ছিল অতি উচ্চাঙ্গের। হাজী কলিমুদ্দীন ছিলেনঅবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ‘লায়লী’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। ডাঃকহরউল্লাহ পেশায় চিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তাঁর গ্রামের বাড়িমহাস্থানের রামশহরে। তিনি ‘মহাস্থান’ নামে যে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেনতাতে মহাস্থানগড়ের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়। এছাড়াও এ সময় যাঁদেরনাম পাওয়া যায়-শাহ মামুদ খন্দকার’র রচনা-শাহ কলন্দর (১৮৭৯)। নাজেরমোহাম্মদ-মোনাই যাত্রা (১৮৭৯)। মোহাম্মদ আরিফ-রঙিন বাহার কাব্য (১৮৮১)।আজমতুল্লাহ খন্দকার-‘ফাতেমার জহুরানাম’ নামে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কন্যা হযরতফাতিমা (রাঃ)-এর জীবন (১৮৯৩)। খলিল উদ্দিন গাইন-‘ভানুমতীর লড়াই’ (১৮৯৮)।সঙ্গীতেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। দুর্গতিয়া সরকার-সম্ভবত তাঁর নিবাস পূর্ববগুড়ার সারিয়াকান্দি থানায়। ‘ইমামযাত্রা’ (১৯০২)। মোহাম্মদ রহিম বক্স, ‘শোকার্ণব’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। বইটি শেখ আব্দুল লতিফ কর্তৃকবগুড়ার চৌধুরী প্রেসে মুদ্রতি (১৮৯৭ সালের ১২ জুন-এর ভূমিকম্পের উপর পথকবিতা পৃষ্ঠা-৭০। মূলঃ ৪ আনা। মুদ্রণ সংখ্যাঃ ১০০০, প্রকাশকালঃ ১৮৯৮ সাল।)

বৃটিশশাসনের মধ্যভাগে আজীমদ্দিন মহাম্মদ চৌধুরী নামে এক যুবক লেখাপড়া ও জীবিকাঅন্বেষণের নিমিত্তে পাবনা থেকে বগুড়া এসেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনরচিত গ্রন্থেবলেছেন আমি বগুড়া যাওয়ার সময় আমার বয়ক্রম প্রায় ১৭/১৮ বছর। দাড়ি মোছেররেখামাত্র হইয়াছে। এই বয়সের গোড়া হইতে বিদ্যাভ্যাস করা নিতান্ত ঘৃণা ওলজ্জাজনক বিবেচনায় এই দাড়ি গোপনে নিজেই ধারালো ছুড়ি দিয়া চাঁচিয়া, ছিলিয়াবালক প্রায় হইলাম। ছেলেকে সাহায্য করার জন্য বগুড়ার জনৈতিক নাজির সাহেবকেপিতা লিখেছেন-‘বেয়াদব আজীবন কদরেসু শ্রীমানকে আপনার নিকট পাঠাইলাম ইহারপ্রতি নেক নজর রাখিবেন ও যাহাতে লেখাপড়া শিক্ষা হয় তাহা করিবেন। পরেআজিমদ্দিন চৌধুরী পুলিশে চাকুরি পেয়েছিলেন। বগুড়া থাকাকালে তিনি ‘জীবনরচিত’ সমাপ্ত করেন ও পরে বরিশাল থেকে এটি প্রকাশ করেন। আত্মজীবনীমূলক রচনার লেখকহিসেবে আজিমদ্দিন মহাম্মদ বাংলা সাহিত্যে প্রথম এবং উনবিংশ শতাব্দীরএকমাত্র মুসলমান আত্মজীবনী লেখক। সাদেকুল্লাহ খাঁ জীবনীমূলক কাব্য‘যুগীকাছের’ (১৮২৭) রচনা করেন।

বাতাসুসরকার বর্তমান জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালের অধিবাসী। তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ‘ছত্ররাজার জঙ্গ’এবং মোনই যাত্রা (১৮৩৮)। রায়হান উদ্দিন ও সাদুল্লাসরকার-‘গোলে আরজান’১৮৭৫ খৃস্টাব্দের দিকে রচনা বলে ধারণা করা হয়। জমশের আলীতালুকদার ‘হোসেন বধ কাব্য’। তিনি ক্ষেতলালের অধিবাসী। কাব্যটি অমিত্রাক্ষরছন্দে রচিত। সৈয়দ আকতার হোসেন-অংশুরেখা।

বৃটিশআমলের মধ্যভাগে বগুড়ার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ প্যারীশঙ্কর দাসগুপ্ত প্রায়১৮টি গ্রন্থ রচনা করেন। সামাজিক উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং চিকিৎসা বিষয়কগ্রন্থ অন্যতম। তিনি ১৮৫৪ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩১ খৃস্টাব্দেমৃত্যুবরণ করেন। তাঁর গ্রন্থগুলোর নাম-আর্য বিধবা, কমলিনী, ফুল ও মুকুল, প্রতাপ সিংহ, যমুনা, রত্নাকর, গার্গী, কর্ণ, লক্ষ্মী, অর্জুন, প্রহলাদ, উমা, গীতা, প্রসাদ ও কুঠির, কৃষ্ণাশ্রম, সংগ্রাম সিংহ, স্ত্রী শিক্ষা, রাধা। চিকিৎসার বই-‘ওলাওঠা’। বগুড়ার দত্তবাড়ী মোড় থেকে নামাজগড় মোড় পর্যন্তপশ্চিমমুখী রাস্তাটি তাঁর নামানুসারে ডাঃ প্যারীশঙ্কর স্ট্রিট নামেপরিচিত।

মানিকউদ্দিন আহমদ, আদমদীঘি থানার অধিবাসী। তাঁর রচিত গ্রন্থটি-খনার বচন, ইসলামসুহৃদ, উপদেশ লহরী, বাংলা শব্দকোষ বা ছাত্র সহচর অভিধান, শোকোচ্ছ্বাস বাবিদায়গীতি।

সুজাত আলী সদর থানার তেলিহারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখা শিশুতোষ গ্রন্থ-‘চাঁদের হাট’।

বগুড়ার সাহিত্যঃ বৃটিশ আমলের শেষ ভাগ-ত্রিশ ও চল্লিশ এর দশক:

এই সময়যাদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন-সোনাউল্লাহ সরকার, কাজী বহরউল্লাহ, হাজীজামালউদ্দিন, চাঁদ মহম্মদ, আছমত আলী, সৈয়দ আফতাব উদ্দিন, মওলবী আয়েনউদ্দিন, কবি একেএম রোস্তম আলী কর্ণপুরী, সাদত আলী আখন্দ, কবি কে. এম শমশেরআলী, কে. এম মেছের, নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান। কাহালু থানার অধিবাসীকাজী বহরউল্লাহ ‘ফুলের ডালা’ নামক গজলগীতি গ্রন্থ রচনা করেন। মাতৃভাষারপ্রতি কবির আকর্ষণের নমুনা-‘সুশিক্ষার শুভ ফল যদি ভোগ কর/যত্ন করে মাতৃভাষাআগে শিক্ষা কর।’ শিকারপুর নিবাসী হাজী জামাল উদ্দীনের ‘বেণুবন’, ছাতিয়ানগ্রামের আয়েন উদ্দিনের ‘পরিণাম’উপন্যাস-এগুলো মোটামুটি সেই সময়ে পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সাদত আলী আখন্দ শিবগঞ্জ থানার চিঙ্গাসপুরেজন্মগ্রহণ করেন। চাকুরি করতেন পুলিশ বিভাগে, চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পরওকালতি পেশা শুরু করেন। ‘তের নম্বরে পাঁচ বছর’ ও ‘অন্যদিন অন্য জীবন’ তাঁরসুলিখিত অভিজ্ঞতামন্ডিত গ্রন্থ। বগুড়ার দুই স্বনামখ্যাত লেখক ভ্রাতৃদ্বয় ড.মুস্তফা নূরউল ইসলাম এবং ‘চরমপত্র’ খ্যাত এম. আর আখতার মুকুলের পিতা ছিলেনসাদত আলী আখন্দ। ১৯৭১ খৃস্টাব্দে অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

এই সময়েবগুড়ার যে দু’জন কবি খ্যাতি অর্জন করেন তাঁরা হলেন-কবি রোস্তম আলী কর্ণপুরীএবং কবি কে. এম শমশের আলী। কবি কর্ণপুরী আমৃত্যু সাহিত্যকে ভালোবেসেগেছেন। কোনো সাহিত্যসভায় ডাক পড়লে সুদূর গ্রাম কর্ণপুর থেকে পায়ে হেঁটে চলেআসতেন। সদর থানার কর্ণপুর গ্রামের এই মানুষটি কাব্যভাবনায় নিজেকে উজাড় করেদেন। খেলাফত ও কংগ্রেস আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘বিশ্বনবী’, ‘বগুড়ারফুলমালঞ্চ’, ‘সোহরাব-রুস্তম’সহ অনেক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। ‘সোহরাব-রুস্তম’ কাব্যখানি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। তাঁর কবিতার মধ্যে নজরুলের প্রভাববিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত আরেক কবি কে. এম শমশরে আলী সদর থানারমন্ডলধরণ গ্রামে জন্ম। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি কাব্য রচনার প্রয়াস পান। তাঁরপ্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলিঙ্গন’ ছাত্রজীবনে প্রকাশ পায়। এটি তিনিরবীন্দ্রনাথের কাছে প্রেরণ করেন এবং পরে কবির আশীর্বাদ লাভ করেন।‘স্বাক্ষর’ সনেট গ্রন্থ এবং অল্পসময়ে তিনি ‘সনেট বিশারদ’ হিসেবে সারাদেশেসুনাম অর্জন করেন। ‘কল্লোল’ আর একটি সন্টে সংকলন। আধুনিক কবিতা, যাকে অনেকেগদ্য-কবিতা বলে আখ্যায়িত করেন, সেই গদ্যকবিতা লেখার প্রচেষ্টার স্বাক্ষরতার আরেকটি গ্রন্থ ‘রমনার কবি’। তিনি কাব্যে এক নিবেদিত প্রাণ কবি ছিলেন।তিনি ১৯৯৯ খৃস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল পরলোকগমন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীপুরস্কারও লাভ করেন।

১৯৪৭-এপাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের বিতর্কিত অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে চল্লিশদশকের অনেক কবি-লেখক নতুন চেতনায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন তাঁদেরই একজননাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান। তাঁর রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস’ সাহিত্যের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভিন্নমতের সন্ধান দিয়েছে। তিনি ড.সুনীতিকুমার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতকে গ্রহণ না করে নিজের ধারণাকেপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে তাঁর এই মতকে সাহিত্য বিশেষজ্ঞরা কেউইসমর্থন না দেওয়ায় পুস্তকটি মোটেই পাঠকের কাছে সমাদর পায়নি। আরেকজন লেখক, তবে ঐতিহাসিক হিসেবে তিনি পরিচিত, কাজী মোহাম্মদ মেছের, ‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’ তাঁর অবদান। রাজশাহী জেলার ইতিহাস লেখকও তিনি। এছাড়াও ‘দাওয়াত-ই-ইসলাম’ নামেও একটি গ্রন্থ আছে তাঁর। প্রবন্ধগুলো পঞ্চাশ-এর দশকের মধ্যেই প্রকাশিতহয়।

পূর্বজদের ভূমিকাঃ চল্লিশ দশক:

‘কত নাসাহিত্য রথী, কবি, শিল্প গুণী জ্ঞানী/বিজয় পতাকা তুলি কত লক্ষ বিদ্যাঅভিমানী/ঘঘারিয়া চলিয়াছে-জয়ারথ করে দিগ্বিজয়/দিকে দিকে, দিশে দিশে। বিশ্বজনগায় জয়/জয় প্রতিধ্বনি আসে তার বগুড়ারো নিভৃত প্রান্তরে।’

তাই তোবিম্ময় আমি মান তরুণের স্পর্ধা দেখে, তবে জানি আমি জানি/হোক না গঙ্গারস্রোত খরতর, হোক না পদ্মার/বিশাল বিপুল বক্ষ, তবু যারা করতোয়ামা’র/মাতৃসত্মন্য করে পান- জানে তারা ক্ষুদ্রের মহিমা, দীনের বিত্ত-বৈভব।ফোটায়েছে হেরো শ্যামলিয়া, ভানুমতী মন্ত্র দিয়া গন্ডীমাঝে যে-লীলা ভঙ্গীতে, তেমনি মুখর হোক এ অঞ্চল ও ‘পত্র’ সঙ্গীতে।

১৯৪৯সালের ১৫ মার্চ বগুড়ার মালতিনগরের এক বাসায় এই ক্ষুদ্র কবিতাটি রচিত হয়েছিলবগুড়া আযিযুল হক কলেজ বার্ষিকীর অধ্যক্ষের আশীর্বাণী হিসেবে। কবিতাটিলিখেছিলেন আযিযুল হক কলেজে সদ্য যোগদানকারী অধ্যক্ষ উপমহাদেশের অন্যতমসুসাহিত্যিক- রম্যলেখক-দার্শনিক চর্চাকাহিনী, দেশে-বিদেশে, শবনম প্রভৃতিগ্রন্থের রচয়িতা ড. সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি কলেজে যোগদান করে অল্প সময়েইলক্ষ্য করেছিলেন বগুড়ার অনেক তরুণের মধ্যে সাহিত্যের প্রাণবহ্নির দীপ্তি।আরও আগে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষা পন্ডিত, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহআযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন বগুড়ার সাহিত্যিক পরিবেশ সৃষ্টিতে‘সাহিত্য আড্ডা’র প্রচলন করেন। মনি সান্যাল নামে এক সাহিত্যমোদীর বাসভবনস্যানাল বাড়ি'তে প্রতি রবিবার বসতো এই সাহিত্য আড্ডা। ড. শহীদুল্লাহ বগুড়াথাকাকালীন পাক্ষিক ‘তকবীর’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সৈয়দ মুজতবাআলীর অনুরূপ ‘সাহিত্য বাসর’ বসাতেন প্রতি বৃহস্পতিবার। এ সময়ের একটি চিত্রপাওয়া যায় কবি আতাউর রহমানের স্মৃতি লেখনীতে- ‘বগুড়া কলেজের কয়েকজন তরুণঅধ্যাপকের কাছে আমরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির পাঠ দিয়েছিলাম। তাঁদেরমধ্যে বিশেষভাবে মনে পড়ে অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক গোলাম রসুল, অধ্যাপকসৌমিত্র শঙ্কর দাশগুপ্ত, অধ্যাপক প্রতিশ দত্ত প্রমুখকে। অধ্যাপক খায়ের এবংগোলাম রসুল সাহেবের বাসায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বসতো আমাদের সাহিত্য আড্ডা।এই সাহিত্য আড্ডার নাম ছিল ‘শিল্পায়ন’। এই সভায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এমনকি একাংকিকা ধরনের নাটকও পড়া হতো।

পূর্বজদের ভূমিকা : পঞ্চাশ থেকে আশির মধ্যবর্তী দশক:

পঞ্চাশদশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ষাটের প্রথমার্ধ সময়ে অধ্যাপক মোহসিন আলী দেওয়ানসম্পাদিত মাসিক ‘অতএব’ পত্রিকাকে ঘিরে একটি সাহিত্য পরিমন্ডল গড়ে ওঠেবগুড়ায়। পঞ্চাশ দশকের অনেক তরুণ লেখক লিখেছেন এই পত্রিকায়। এঁদের মধ্যেআছেন কবি আতাউর রহমান, লুৎফর রহমান সরকার, কমলেশ সেন, খাজা জহুরুল ইসলাম, শাহ আনিসুর রহমান প্রমুখ। ষাটের তরুণদের মধ্যে ফারুক সিদ্দিকী, আনওয়ারআহমদ, বজলুল করিম বাহার সহ অনেকেই লিখেছেন ‘অতএব’ পত্রিকায়। ষাটের মাঝামাঝিফারুক সিদ্দিকী সম্পাদিত ‘বিপ্রতীক’ কবিতাপত্রকে ঘিরে বেশ কিছু তরুণ তাদেরসাহিত্য প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যান। স্বাধীনতার পর ছড়া সংসদ ও কবিতা সংসদনামে সংগঠনকে ঘিরে সত্তর দশকের অনেক তরুণ নিজেদের সাহিত্য ভূমিতে দাঁড়ানোরচেষ্টা করেন। তবে সংগঠনের চাইতে পত্র-পত্রিকাকে ঘিরেই সাহিত্যের আতপ্তভূমিতে তাঁরা পা রাখতে সচেষ্ট হন। ১৯৭৪ -এ এবং ১৯৭৯-তে যথাক্রমে অনুকালসাহিত্য গোষ্ঠী এবং বগুড়া লেখক গোষ্ঠী ষাট ও সত্তর দশকের লেখকদের একত্রিতকরার প্রয়াস চালায়। তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বগুড়ার সাহিত্যমোদী এবং সুধীসমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৮১-র ১৫ মার্চে বগুড়া লেখক গোষ্ঠীআয়োজিত দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল।১৯৮১-তে এবং ১৯৮৫-তে যথাক্রমে কবি শামসুর রহমান এবং কবি আব্দুল মান্নানসৈয়দকে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৯৮৬ পর্যমত্ম এরকার্যক্রম অব্যাহত ছিল।

বগুড়ার সাহিত্য : আধুনিককাল-পঞ্চাশ-এর দশক:

পঞ্চাশ-এরদশকে বগুড়ার উল্লেখযোগ্য কবি-লেখকদের আবির্ভাব বগুড়ার সাহিত্যাঙ্গনকে সচলকরে তোলে। তাঁরা মননে-মেধায় ছিলেন তাঁদের পূর্বজদের চেয়ে অগ্রগামী। তাঁদেরঅর্জিত শিক্ষাকে যেমন তারা সামাজিক সত্মরে আত্মপ্রতিষ্ঠার কাজেলাগিয়েছিলেন, তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রকে উন্নত চিমত্মার আধার করেতুলেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারায় তাঁরা স্নাত হয়েছিলেন। পঞ্চাশ-এরদশকে এদের সাহিত্য নতুন করে গতি পেতে শুরু করে। সাতচল্লিশে পাকিসত্মানসৃষ্টি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, আটান্নতেসামরিক শাসন-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ছিল বিস্তৃত। সামাজিক সত্মরে চলেছে নানাপরিবর্তন। সাহিত্যচর্চা যাঁরা করেছেন তাঁদের রচনায় আছে সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট। এই সময় বগুড়ায় যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেছেনতাঁরাও এসব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁরা কবিতায়, গল্পে, নাটক ও অন্যান্যলেখায় বিষয়ের বিস্তৃতি ঘটাতে পেরেছেন। বগুড়ায় এই সময় যাঁদের পাচ্ছি তাঁরাহলেন- অধ্যক্ষ খোদেজা খাতুন, রোমেনা আফাজ, আতাউর রহমান, লুৎফর রহমান সরকার, তাজমিলুর রহমান, এম শামসুল হক, মীর্জা আমজাদ হোসেন, মুহম্মদ আব্দুল মতীন, সাইফুল বারী, ড. মুসত্মাফা নূরউল ইসলাম, খোন্দকার আজিজুল হক, এম আর আখতারমুকুল, শামস রশীদ, আনোয়ারা রহমান এ্যানা, টিপু সুলতান, মুহম্মদ নুরুলইসলাম, নুরুল ইসলাম মন্ডল, শেফালী রহমান, ডাঃ আব্দুল করিম, একে মজিবররহমান, সৈয়দ ওমর আলী চৌধুরী, মতিয়র রহমান কবিরাজ, বিলোরা চৌধুরী, সৈয়দআফতাব হোসেন, অধ্যাপক মোহসীন আলী দেওয়ান, শাহ আনিসুর রহমান, জাহাঙ্গীরচৌধুরী, মাফরুহা চৌধুরী, সাজেদুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, আসাফ-উদ-দৌলারেজা, ডাঃ নীন গোপাল দেবদাস, হাসনা আকরাম, গাজীউল হক, জগলুল হায়দার আফরিফ, মমতাজুর রহমান, আব্দুল মজিদ, আতাউল হক, সুলতানা রহমান, শামসুদ্দীন তরফদার, আব্দুল মজিদ ফকির, প্রসাদ বিশ্বাস, আমজাদ হোসেন, মুহম্মদ ফজলুল হক, আবেদআলী আহমদ প্রমুখ।

প্রতিকৃতির কিছু তথ্যায়ন:

অধ্যক্ষাখোদেজা খাতুন ১৯১৭ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবি কেএম শমসের আলীরছোট ভগ্নি। তিনি এই জেলার প্রথম মুসলিম মহিলা এম, এ। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী-বেদনার এই বালুচরে (কবিতাগ্রন্থ), গল্পগ্রন্থ- সাগরিকা, রূপকথার রাজ্যে, শেষ প্রহরের আলো, একটি সুর একটি গান। প্রবন্ধ- বগুড়ার লোকসাহিত্য, সাহিত্যভাবনা, আমার দীর্ঘতম ভ্রমণ, রম্যরচনা, অরণ্যমঞ্জরী। এছাড়াও‘শতপুষ্পা’ নামে ৩ খন্ডে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেন। ঢাকাইডেন কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে তিনিমৃত্যুবরণ করেন।

রোমেনাআফাজের জন্ম ১৯২৬ খৃষ্টাব্দে। মূরত ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ কাহিনী লিখে তিনিখ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু উপন্যাস রচনাতেও তাঁর ছিল সমান দক্ষতা। ‘বনহুর’ সিরিজের মোট সংখ্যা ১৩২। ‘দস্যুরাণী’ সিরিজ ১২টি। উপন্যাসের সংখ্যা ৬০।‘কাগজের নৌকা’ সহ প্রায় ছয়টি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। ‘মান্দীগড়েরবাড়ি’ নামে একটি কিশোর উপন্যাসও তিনি লিখেছেন। সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণরোমেনা আফাজ ২০০৩ সালে লোকামত্মরিত হন।

তাজমিলুররহমানের জন্ম ১৯২৫ সালে। তিনি নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর রচিত কয়েকটিনাটকের মধ্যে অন্যতম- কলির জিন, ভাই, রূপচাঁন, সুবেহ উম্মিদ, কারিগর, অনেকআঁধার পেরিয়ে, টোপ যেমন খুশি সাজো। কিশোরদের জন্য লিখেছেন উপন্যাস-জুলফিকারের অভিযান, সুন্দরবনে জুলফিকার, ভূতের কবলে জুলফিকার। রম্যরচনা-অমৎসর, লঘুগুরু। তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম- প্রবন্ধ সংগ্রহ।

আতাউররহমান, জন্ম ১৯২৫। বর্তমানে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরে। বাংলাদেশেপঞ্চাশ-এর দশকে ত্রিশ-এর দশক লালিত আধুনিক কাব্যভাবনা বগুড়ার কবি আতাউররহমানের কবিতায় ব্যাপ্তি লাভ করে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দুই ঋতু’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে। ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘নিষাদ নগরে আছি’, ‘ভালবাসা চিরশত্রু’, ‘ইদানিং রঙ্গমঞ্চ’, ‘ভালবাসা এবং তারপর’ ও ‘সারাটাজীবন ধরে’। তিনি নজরুল বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর গবেষণাগ্রন্থ-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, নজরুল কাব্য সমীক্ষা, নজরুলজীবনে প্রেম ও বিবাহ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমীপুরষ্কার পান। তিনি ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দের ৩০ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

শিবগঞ্জ থানার লেখক আতাউর হক। জন্ম ১৯২৯। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ ‘অঙ্গীকার, মহানবীর অমর বাণী, রক্তশিখা, মুসলিম দর্শন ইত্যাদি।

শামসুদ্দীনতরফদার। তাঁর জন্ম ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে সারিয়াকান্দি থানার নারচী গ্রাম। তিনি‘দুই শতাব্দীর বুকে’ গ্রন্থখানিতে বগুড়ার ইতিহাস ও জেলার জ্ঞানীগুণীব্যক্তিদের পরিচিতি তুলে ধরেছেন। ‘পল্লীচিত্র’ নামে একটি নাটকও লিখেছেন।

শামস্রশীদ অজস্র উপন্যাস রচনা করেছেন। জন্ম ১৯২০ খৃষ্টাব্দে। উপল উপকূলে (২য়খন্ড), নীলাঞ্জনা, প্রাণ বসমত্ম, হৃদয় উপবনেসহ প্রায় ১৫টি উপন্যাস এবংশিশুতোষ গ্রন্থ ‘সমুদ্র নাবিক’ রচনা করেন। তিনি পরবর্তীতে বাংলা একাডেমীপুরষ্কার লাভ করেন।

ড.মমতাজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক।ইতিহাস বিষয়ক বেশক’টি গ্রন্থ প্রণেতা। ১৯৭৭ খৃষ্টাব্দে বাংলা একাডেমীপুরষ্কার লভ করেন। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালে সদরের মেঘাগাছা গ্রামে।

মীর্জাআমজাদ হোসেন সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত অর্জন করলেও লেখক হিসেবে সুনামকুড়িয়েছেন। শিশুতোষ রচনা- কচিদের মহানবী, কচিদের আবু বকর, কচিদের ওমর ওআলী, হিরা মানিকের দেশ, বড় হওয়ার গোপন কথা, মরু ভাস্কর, পাহাড়ী দেশে স্বপনকুমার, অবমত্মীপুরে স্বপন কুমার ইত্যাদি। রঙের বাজারে পঁয়তাল্লিশ বছর, আত্মজীবনীমূলক রচনা লেখার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আনোয়ারারহমান এ্যানা ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। কবি আতাউর রহমানের স্ত্রী, তাঁর রচিত উপন্যাস- আমার বধূয়া, গল্পগ্রন্থ- অমত্মলীন, গল্পমঞ্জরী, পুষ্পবাগ এবং কাব্যগ্রন্থ- প্রিয় পঙক্তিমালা, জননী আমার অহঙ্কার। তিনি‘উত্তর নক্ষত্র’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

টিপুসুলতান এক সময় ভালো গল্প লিখতেন। তাঁর সম্পর্কে কবি বেলাল চৌধুরীর উক্তিটিস্মরণীয়-‘হাসান হাফিজুর রহমানের সূত্রে পরিচয় হলো এক উজ্জ্বল মেধাবী যুবকেরসঙ্গে। অভিভাবকের একামত্ম বাধ্যগত ছেলে বগুড়ার টিপু সুলতান এসেছে ঢাকায়পড়াশুনার ব্রত নিয়ে। টিপু তখন বেশ কয়েকটি নজরকাড়া গল্প লিখে ফেলেছেন।‘সমকাল’-এ প্রকাশিত ‘ডাহুক’ তো রীতিমতো একটা ভালো গল্প। জহির রায়হানসম্পাদিত ‘প্রবাহতেও’ একটি চমৎকার গল্প বেরিয়েছিল টিপু’র। এরকম একসম্ভাবনাময় লেখকজীবন কেন যে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল তা আজও আমার কাছে একবিস্ময়।’ কয়েক বছর আগে তিনি লোকামত্মরিত হয়েছেন।

খন্দকারমুহম্মদ আজিজুল হক। ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে দুপচাঁচিয়া থানার তালোড়ায় জন্মগ্রহণকরে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ‘হয়তোনক্ষত্র নয়’ তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ। তাঁর গবেষণাগ্রন্থ-ভাষাতত্ত্বের নতুনদিগমত্ম ও আধুনিক ভাষাতত্ত্বের, নৈরাজ্য, অসঙ্গতি ইত্যাদি। তিনি ভাষারসরসতায় তুলে ধরতে অভ্যসত্ম। ‘দৈনন্দিন’, ‘জীবন যেখানে যেমন’ গ্রন্থগুলোতারই উজ্জ্বল উদাহরণ।

সাইফুলবারী কবিতা, নাটক এবং ছোটগল্প লিখেছেন। কবিতা গ্রন্থ- ‘দুই বিপরীত মেরুতে’, ‘একটি জীবন, জীবনের দৃষ্টিকোণ, ‘ভাগ্য কে ফেরাবে আমার’, ‘ক্রমাগত আমি’।টেলিভিশনের জন্যে তিনি নাটক লিখেছেন। ‘জোনাকী জ্বলে’ সিরিজ নাটকটি অন্যতম।গানও রচনা করেছেন। ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে পর্যমত্ম তিনি জাতীয় সম্প্রচারকর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।

বগুড়াসাহিত্য কুটির-এর কর্ণধার এম শামসুল হক নাটক ও উপন্যাস লিখেছেন বেশ কয়েকটি।‘একদিনের কাহিনী’, ‘মিথ্যার খেসারত’ তাঁর রচিত নাটক। একজন নাট্যমোদী এবংনাটকসহ অনেক গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছেন। তাঁর উপন্যাসের নাম- ‘ফরিয়াদ’, ‘প্রেমের শেষ চিঠি’, ‘পলাতকের চিঠি’।

মুহম্মদআব্দুল মতীন সাংবাদিক হলেও তিনি একজন ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু। প্রবন্ধ রচনায়সিদ্ধহসত্ম। তাঁর অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে সুধী সমাজেরদৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর প্রগাঢ়আকর্ষণ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তার ‘দাঁড়কাকের ডায়েরী, বুড়ো পৃথিবী’ উল্লেখযোগ্য রচনা।

ড.মুসত্মাফানুরউল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর রচিত ‘মুসলিমবাংলা সাময়িক পাঠকদের মধ্যে দারুণ আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। রওশন আখতার, যিনিএম আর আখতার মুকুল নামে পরিচিত। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’ পাঠক। যাঁর কণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদেরমনে উৎসাহ যোগাতো,সেই এম আর আ্খতার মুকুল স্বাধীনতার পরে অনেক গ্রন্থ রচনাকরেছেন। তিনি একজন স্পষ্টবাদী লেখক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থেরমধ্যে ‘আমি বিজয় দেখেছি’, ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ বিশেষ খ্যাতিঅর্জন করেছে।

ড.মুসত্মফা নূরউল ইসলাম এখন ঢাকা থেকে ‘সুন্দরবন’ নামে সৃজনশীল একটিত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের চেয়ারম্যান এবং শিল্পকলা একাডেমী মহাপরিচালকের পদ অলংকৃত করেন।

শাহআনিসুর রহমান প্রথমে অধ্যাপনা ও পরে সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনিরাজশাহী থেকে দৈনিক বার্তার সিনিয়র সহ-সম্পাদরেক দায়িত্ব পালন করেন।‘আড্ডা’ নামেতাঁর গল্পগ্রন্থ আছে।

ড. এনামূলহক ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরেরমহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ষাট দশকের প্রথমাবধি সিকান্দার আবু জাফরের ‘সমকাল’ সাহিত্য পত্রিকার পাশাপাশি ‘উত্তরণ’ নামে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন।উত্তরণের দেশে, হাজার তারের বীণাসহ তাঁর প্রায় ১২টি কাব্যগ্রন্থ এবং ইসলামীকৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিষয়ক বেশকিছু গ্রন্থ বিদ্যমান। টেলিভিশনে তাঁরউপস্থাপনায় ১দেখা যায় নাই চক্ষু মেলিয়া’বাংলাদেশের পুরাকীর্তি বিষয়ক চমৎকারঅনুষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। ইঞ্জিনিয়ার মুহম্মদ নূরুল ইসলাম, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধমীয় গ্রন্থ রচনায় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনিসারিয়াকান্দি থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত ‘পৃথিবী ঘোরে না সূর্যঘোরে, বৈজ্ঞানিক মুহম্মদ, বিজ্ঞান না কোরান, ঝংকার’ ইত্যাদি বেশ আলোড়নসৃষ্টি করে। নূরুল ইসলাম মন্ডল জন্ম ১৯৩৩, ১লা অক্টোবরে সারিয়াকান্দউপজেলার হাটশেরপুরে। মনীষী একাদশ, নারীর মূল্যায়ন ও আল্লাহর ভাষায় রাসুল(সঃ) নামে তিনখানি গ্রন্থ রচনা করেন।

মাফরুহাচৌধুরী ১৯৩৬-এ কাটনারপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবি তালিম হোসেনের স্ত্রীএবং প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শবনম মুসত্মারীর মাতা। মূলত গল্পকারহিসেবে তিনি খ্যাত। অরণ্যগাথা ও অন্যান্য গল্প,স্মলিত নক্ষত্র সহ প্রায়১০টি গল্পগ্রন্থ, দু’টি উপন্যাস এবং তিনটি কাব্যগ্রন্থ আছে। প্রবন্ধগ্রন্থ-ক্রামিত্মকালের ছায়া, সঙ্গ-প্রসঙ্গ। শিশুতোষ রচনা- একটি ফুলের জন্য, পানিতে কখনো আগুন লাগে। তাঁর দুটি অনুবাদগ্রন্থ আছে।

জাহাঙ্গীরচৌধুরী যাঁর মূল নাম মফিজ চৌধুরী,জয়পুরহাট জেলার মঙ্গলবাড়ী গ্রামে ১৯১৪খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক সময় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীত্ব পদঅলংকৃত করেন। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন।তাঁর অনুদিত ‘আধুনিক কোরিয়ার কবিতা’বেশ সুনাম অর্জন করে। এছাড়াওশেক্সপীয়রের কিং লিয়র,রোমিও জুলিয়েট, এন্টনী ও ক্লিওপেট্টা তিনি অনুবাদকরেন। তাঁর উপন্যাসের নাম সোনালী প্রহর, বটতলার ঝড় এবং স্মৃতিকথাঃবঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভায়। ১৯৯৩ খৃষ্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন। শহীদ অধ্যাপকমোহসীন আলী দেওয়ান অধ্যাপনা পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের একজননিবেদিতপ্রাণ মানুষ ছিলেন। তিনি ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে জয়পুরহাট জেলায় জন্মগ্রহণকরেন। তিনি বগুড়া প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। শিশুতোষ রচনা‘গল্পের চিড়িয়াখানা ও প্রথমা’চমৎকার গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকইতিহাস,ছন্দ পরিচয় তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। নাটিকা-নীলরক্ত। তার সম্পাদনায় ষাটদশকের প্রথমার্ধে ‘অতএব’সাহিত্য পত্রিকা লেখক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালনকরে। তাঁর সম্পাদনায় বগুড়া বুলেটিন, উত্তরবঙ্গ বুলেটন, বগুড়া বার্তাইত্যাদি সংবাদ-নিবন্ধজাতীয় পত্রিকা বেশ সুনাম অর্জন করে। শেরপুর কলেজেরঅধ্যক্ষা থাকাকালীন ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর হাতে ধৃতএবং নিহত হন।

কবিজেব-উন-নেছা জামাল ১৯২৬-এ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত গীতিকার হিসেবেসুপরিচিত। তিনি কল্পশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগমের বড় বোন এবং কণ্ঠশিল্পীজিনাত রেহানার মা। তাঁর রচিত গ্রন্থ- আমার যত গান, গান এল মোর মনে, সাগরেরতীর থেকে। অনুবাদ গ্রন্থ- ‘বেল সাহেবের টেলিফোন আবিষ্কার’ এবং গল্পগ্রন্থ-‘হারানো দিনের গল্প’। গাজীউল হক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবংরাজনীতিবিদ। পেশায় একজন আইনজীবী হলেও তিনি ‘জেলের কবিতা’ লিখে সুনাম অর্জনকরেন। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের নাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাংলাদেশ আন চেইনড ইত্যাদি। জন্ম: ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে।

হাসনাআকরাম ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচনার মধ্যেকবিতাগ্রন্থ- সংবতীকা, গল্পগ্রন্থ-হাসি কাশী বিড়ালী, উপন্যাস- এক পলকে, একনদীর দুই কিনারা, শিশুতোষ রচনা- ছবি দেখে ছড়া, রঙিন প্রজাপতি উল্লেখযোগ্য।

আবেদ আলীআহমদ, স্বভাব কবি। জন্ম ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে বগুড়ার গাবতলীতে।তাঁর কাব্যগ্রন্থ- প্রেমের বাঁশরী (১৯৬২), স্বর্গের মত বেঁচে থাকা, রক্তেভেজানো বাংলা আমার, গীতিমঞ্জরী, আমার প্রিয়া আর আমি দু’জনে একজন ইত্যাদি।মৃত্যুঃ ১৯শে এপ্রিল ২০০৭।

মাহমুদাআখন্দের ‘বিজয়ননী’ ও ‘রঙ-বেরঙ’, শেফালী রহমানের ‘প্রীতি নয় স্মৃতি’ ও ‘শ্লোপয়জন’ এবং জাহানারা হকের ‘ফুলের বিয়ে’, আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের মডেল, বিচিত্রা-উপন্যাস ও রহস্যোপন্যাস কালনাগিনী, ভাইপারের মরণ ছোবল, মৃত্যুলোভীভাইপার। সৈয়দ ওমর আরী চৌধুরীর ‘প্রিলুড ইন বাংলাদেশ’। আব্দুর রাজ্জাকের‘কন্যাকুমারী’ উপন্যাস, সাংবাদিক আসফ-উদ-দৌলা রেজার রাজনীতি ও সরকার, মুহম্মদ ফজলুল হকের ‘তৃষ্ণার্ত বিহঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থ, জগলুল হায়দার আফরিকেরবিপ্লবী নায়িকা, সিন্ধু নামার দেশে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য রচনা হিসেবে পাঠকমহলে স্বীকৃতি লাভ করতে পেরেছে। ডাঃ আব্দুল করিমের ‘ভ্রমণ কাহিনী’ পথেপ্রবাসে, আব্দুল মজিদ ফকীরের নিউইয়র্ক ভ্রমণ’ উল্লেখযোগ্য রচনা।

এই সময়এডওয়ার্ড ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চকে ঘিরে বেশকিছু নাট্যকার নাটক রচনায় মনোনিবেশকরেন। প্রসাদ বিশ্বাসের নাজেহাল, উত্তরের স্বপ্ন, অবাক পৃথিবী, অবিচার, জবাবদিহিতা, পাকা রাসত্মা, আমজাদ হোসেনের স্বামী-স্ত্রী, ফিফটি ফিফটি, জালাল উদ্দিনের শহীদ তিতুমীর, শোণিতধারা উল্লেখযোগ্য।

বগুড়ার সাহিত্য : ষাট-এর দশক : প্রথমার্ধ :

বগুড়ায়ষাট-এর দশকের প্রথমার্ধে অধ্যাপক মোহসিন আলী দেওয়ানের ‘অতএব পত্রিকাকে ঘিরেএকটি সাহিত্য পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল। ‘অতএব’ আধুনিক সাহিত্যয়ীতিকে পুরোপুরিধারণ করেনি। রহীম চৌধুর, কমলেশ সেন, খাজা জহুরুল হক, মহীউদ্দীন, আবু আফতাব, মোহসিন আলী দেওয়ান, শাহ আনিসুর রহমান এবং পরবর্তীতে ষাটের শক্তিধর কবিদেরমধ্যে ফারুক সিদ্দিকী, মহাদেব সাহা, বজলুল করিম বাহারের লেখা প্রকাশপেয়েছে। ১৯৬২ তে ‘অতএব’ সাহিত্য পুরষ্কার দেওয়ার কতা ঘোষণা করা হয়েছিল এবংবগুড়া জেলার কবি-সাহিত্যিকদের জীবনী সংগ্রহের এক মহতী উদ্যোগ ‘অতএব’-এরপক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ জাতীয় উদ্যোগ সাথর্ক হয়েছিল কি-না সেসম্পর্কে বেশি কিচু জানা যায় না। আমান উল্লাহ খান, রহিম চৌধুরী দু’জনেষাট-এর দশকের তুখোর ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমান উল্লাহ খানরাজনীতির সাথে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দৈনিকইত্তেফাকের উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি। তাঁর রচিত ‘আজকের বগুাড় জেলারপরিচিতিমূলক একটি চমৎকার গ্রন্থ। অনেক মেঘ, লাল মাটির আর্তনাদ তাঁর রচিতগ্রন্থ। তিনি ১৯৬৮ তে ‘নতুন দিন’নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।স্বাধীনতা উত্তরকালে তার সম্পাদিত ‘দৈনিক বাংলাদেশ’ উত্তরাঞ্চলের প্রথমদৈনিক হিসেবে পরিচিত। রহিম চৌধুরী চাকুরিসূত্রে বগুড়া ত্যাগ করেছিলেন। তাঁরএকটি কাব্যগ্রন্থ ‘প্রতীক্ষা’ অনেক পরে প্রকাশিত হয়। তিনি বর্তমানে দৈনিকপত্রিকায় কলাম লেখক হিসেবে পরিচিত। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিকক্রিয়াকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। আবু বকর সিদ্দিক-এর ‘পূর্ব বগুড়ারপল্লী সাহিত্য (গবেষণা গ্রন্থ) (১৯৬৩), বন্ধু বিচ্ছেদ (১৯৬৮), বান্ধব বডি(নাটক) ১৯৭০ প্রকাশিত হয়। খাজা জহুরুল হক বর্তমানে জয়পুরহাটে আইন ব্যবসারসঙ্গে জড়িত। তাঁর কয়েকটি ছোটগল্প সেই সময় বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। পরবর্তীতেতিনি লেখালেখি ছেড়ে দেন।

১৯৬২-তেমোহসীন আলী দেওয়ান সম্পাদিত ২টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। একটির নাম ‘গল্পেরচিড়িয়াখানা ও ‘প্রথমা’। ‘গল্পের চিড়িয়াখানা সেই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়েপাঠ্যপুসত্মক হিসেবে পঠিত। এই গ্রন্থে মোট ৯টি গল্প আছে। লিখেছেন- রহীমচৌধুরী, কমলেশ সেন, মোহসীন আলী দেওয়ান, লুৎফর রহমান, শাহ আনিসুর রহমানপ্রমুখ।

প্রফেসরমুহ. মাহফুজুর রহমান বগুড়া জেলার ধুনট থানার ঝিনাই গ্রামে ১৯৪১ সালেজন্মগ্রহণ করেন। তার লেখা ‘ফকীর সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’, ‘ওয়াহ্হাবী আন্দোলন ওবগুড়া’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মহাতাব উদ্দিন আহম্মেদ। যার ৫টি কাব্যগ্রন্থও ৫টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কাব্য ‘জীবন বীণা’ ‘বাশের বাঁশরী’, ‘সুরতরঙ্গ’, ‘স্ফুলিঙ্গ ও ঝংকার’ উপন্যাস-‘মৃগ-তৃষ্ণিকা’, ‘পুনর্মিলনী’, অমিত্মম মিলন ও দুখিনী বঙ্গ জননী মুক্তিযুদ্ধ ও একটি বিপর্যসত্ম প্রেম।তিনি সাহিত্যে ‘কবি জসিম উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার’ ১৯৯৫ পেয়েছেন।

বগুড়ার সাহিত্য : ষাট-এর দশক : দ্বিতীয়ার্থ

ষাট দশকেরমধ্যবর্তী সময়ে পঞ্চাশ-এর দশকের কবিতা ও গল্পকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকএবং বিষয় বৈচিত্র্য নিয়ে প্রাণবমত্ম একদল তরুণ হাত রাখেন সাহিত্যের উত্তপ্তভূমিতে। সাহিত্যের এই পালাবদলে নিঃসন্দেহে চমক ছিল, ছিল ভিন্নতর স্বাদ।এদের খোলামেলা বক্তব্যের সহায়ক ছিল নিজেদেরই সম্পাদিত কবিতা ও গল্প পত্রিকাযা ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নামে অভিহিত। ষাটের প্রথমার্ধে ঢাকা থেকে প্রকাশিতহচ্ছিল- বক্তব্য, স্বাক্ষর, সাম্প্রতিক, কালবেলা, না, কণ্ঠস্বরসহ আরো কিছুপত্রিকা। সাহিত্যের উদ্দীপ্ত তারুণ্য নিয়ে তখন আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আসাদচৌধুরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক প্রমুখএগিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য জেলার মতো বগুড়া জেলাতেও ষাট-এর দশকের মধ্যবর্তীসময় থেকে একদলউচ্চাকাঙ্ক্ষী সাহিত্যপ্রেমী তরুণ তাদের স্বল্প ক্ষমতাকে কাজেলাগিয়েছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্যের এক অনুকূল আবহাওয়া।

বগুড়ার সাহিত্যঃ লিটল ম্যাগাজিন ও ষাটদশকী লেখকবৃন্দ:

আধুনিকসাহিত্যের দিগ্বলয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বগুড়ার কিছু সাহিত্যকর্মী ষাট দশকেরমধ্যবর্তী সময়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন। বয়সে এরাছিলেন সবাই তরুণ। তারুণ্যের সেই রক্তিম উচ্ছ্বাসের উদ্বেলিত হয়ে নিজেরাইপত্রিকা সম্পাদনের মাধ্যমে তাঁদের শক্তিমত্তা জানিয়ে দিতে থাকেন। বগুড়ারসাহিত্যের অঙ্গন হয়ে ওঠে মুখরিত। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্তকরে ষাট দশকে যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেন তাঁরা হলেন-ফররুক সিদ্দিকী, কাজী রব, সাহেদুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মনোজ দাশগুপ্ত, বজলুল বাহার করিমবাহুর, সাইফুল ইসলাম, সাম হেদায়েতুল্লাহ, রেজাউল করিম চৌধুরী, খন্দকারআব্দুল রহিম হীরু। এখানে আরো দু’জন তরুণের নামোল্লেখ করতে চাই, তাঁরাবিভিন্ন জেলার অধিবাসী হলেও তাঁদের সাহিত্যযাত্রা শুরু বগুড়ায়। তাঁরাহলেন-কবি মহাদেব সাহা এবং প্রয়াত কবি শাহনূর খান। বগুড়ায় নতুনকাব্যান্দোলনে তাঁরাও ছিলেন সক্রিয়। ষাট দশকের মধ্যবর্তী সময়ে লিটলম্যাগাজিন ‘বিপ্রতীক’ ও ‘পদধ্বনি’ আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়েই বগুড়ায় নতুনকাব্যযাত্রা শুরু হয়। বিপ্রতীক সম্পাদনা করেছেন ফারুক সিদ্দিকী, কাজী রবএবং মহাদেব সাহা। পরবর্তীতে শুধু ফারুক সিদ্দিকী। ‘পদধ্বনি’ সম্পাদক ছিলেনমুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মনোজ দাশগুপ্ত। আরো কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন এই সময় বেরহয়। নূর মোহাম্মদ তালুকদার সম্পাদিত ‘স্বরক্ষেপ’, রেজাউল করিম চৌধুরী ওসাইফুল ইসলাম সম্পাদিত ‘অপরাহ্ন’, শাহনূর খান ও আরেফুল ইসলাম সম্পাদিত‘অবেলা’। ফারুক সিদ্দিকীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্বরচিহ্নে’ ফুলের শবপ্রকাশিত হয় ১৯৭২-এ।

গ্রন্থটিরপ্রকাশক ছিলেন রেজাউল করিম চৌধুরী। তাঁর কবিতা আপাত জটিল হলেও স্বভাবে‘রোমান্টিক’ শব্দতাড়িত। এই কবির আর কোনো কাব্যগ্রন্থ বের হয়নি। অনুবাদকর্মেও তিনি সিদ্ধহসত্ম। প্রবন্ধেও তাঁর সমান দক্ষতা। সম্প্রতি বেরিয়েছেতাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘তামসিক নিসর্গে ঈশ্বরনামা ও অন্যান্য’। তাঁর সম্পদিত‘বিপ্রতীক’কবিতাপত্রটির ইতোমধ্যেই ছাবিবশটি সংখ্যা বেরিয়ে গেছে। ফারুকসিদ্দিকী পত্রিকা সম্পাদনার জন্য ১৯৮৯-এ বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার পেয়েছেন।

একজনবহুপ্রসূ কবি হিসেবে কাজী রবের পরিচয়। তাঁর কবিতায় একইসঙ্গে রাজনীতি, প্রেম, আমত্মর্জাতিকতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ এই পাঁচ বছরেরতাঁর ৫টি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। গ্রন্থগুলোর নাম ‘ফণিমনসার সানগ্লাস’, ‘তুমি হে দুধের মাছি’, ‘আবাবিল ও বিশল্যকরণীর মার্চ এপ্রিল’, ‘পাখিরপার্লামেন্ট’ ও নক্ষত্রের নিকোটিন’। মৃত্যুর পর তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ‘চোখ এক জলের সংসার’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার লাভ করেন।১৯৯৬ খৃস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল তিনি পরলোক গমন করেন।

বজলুলকরিম বাহার বগুড়ার সাহিত্যাঙ্গনের একজন সক্রিয়া লেখক। অনুবাদেও তিনিপারঙ্গম। তাঁর কোনো কবিতার বই বের হয়নি। তিনটি প্রবন্ধের বই আছে-‘সমকালীনকবিতার দিগ্বলয়’ ‘নানা অনুভবে’ ও ‘কথার মেওয়াসকল’। ছো গল্পের বই ‘হেবৃক্ষলতা’ লেখক হিসেবে ১৯৮৯ বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার লাভ করেন।

সাহেদুররহমান ছাত্রাবস্থায়-‘বিপ্রতীক’ কবিতাপত্রে বগুড়ার পাঁচজন কবির ৫টি কবিতাইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ আছে। কাব্যগ্রন্থ ‘প্রচ্ছদপট’।প্রবন্ধ ‘অভিনয়ে নড়াচড়া ও কথা বলা’। অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে দিয়ে বর্তমানেচলচ্চিত্র জগতের কাহিনী লেখক হিসেবে জীবকা বেছে নিয়েছেন।

মুহম্মদশহীদুল্লাহ কবিতা-প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর সাতটি কাব্যগ্রন্থ-ভিজে মাঠেররাখাল বালক (১৯৯০), দুই প্রহরের রোদ (১৯৯২), বাদামী বৃক্ষলিপি (১৯৯৪), বিচূর্ণ কবিতা (১৯৯৬), দূর থেকে আরো দূর (২০০০), অমত্মর্গত কবিতা সকল(২২০৩), হে কবিতা জীবন (২০০৭), প্রবন্ধ গ্রন্থ ৫টিঃ কবিতা অনুষঙ্গ ওঅন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৯১), জহির রায়হান ও তাঁর শিল্প ভূবন (২০০১), শব্দ ওনৈঃশব্দ্য (২০০৪), দুই কবিঃ রৌদ্র দিনের সহযাত্রী (২০০৫) ও কয়েকজন কবিঃঅমত্মরঙ্গ আলোকে (২০০৬)। সম্পাদনাঃ কবি কাজী রব নিবেদিত কথামালা (২০০০)।তাঁর সম্পদিত পত্রিকার নাম ‘দধ্বনি’, ‘অনুকাল’, ‘অর্কেস্ট্রা’, ‘ঐতিহ্য’, ‘আত্মপ্রকাশ’, ‘নির্বাচিত কবিতা’। ১৯৮৯-এ বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার লাভকরেন তিনি।

মনোজদাশগুপ্ত ষাট দশকের একজন রোমান্টিক জীবনবাদী কবি। তাঁর একমাত্র কবিতাগ্রন্থ‘সজল বৃক্ষের দিকে’ তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৯৭ খৃস্টাব্দে ৬সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম গল্প ও কবিতা লিখতেন।রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ‘বাংলা সাহিত্যসারণি’ তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। সাহিত্যের কাল নির্ণয়ের ক্ষেত্রেএটি সহায়ক। মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, স, ম হেদায়েতুল্লাহ এবং রেজাউল করিমচৌধুরীর মিলিত প্রচেষ্টা সাহিত্য পত্রিকা ‘অপরাহ্ন’। স, ম হেদায়তুল্লাহরকবিতা ও আলোচনার তীক্ষ্ণ হাত ছিল। রেজাউল করিম চৌধুরী ষাট-এর দশকের আরেকশক্তিশালী কবি। কবিতার ভাষা ও শব্দচয়নে তিনি পরিশ্রমী। ‘ভালমন্দেরঅপরাহ্ন’, ‘পরাজিত শালিকের অনুশোচনা’, চাঁদের হাতে তরবারি’, সহ ছয়টিকাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বলিষ্ঠ সম্পাদনায় ‘অর্কেস্ট্রা’ সাহিত্যপত্র ইত্যেমধ্যে পাঠ মহলে আদৃম হয়েছে। খন্দকার আব্দুর রহিম ছোটগল্পলেখক। ষাট দশকে বগুড়া জেলার লেখক যাঁরা জীবিকাসূত্রে বাইরে অবস্থান করেছেনতাঁদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আনওয়ার আহমত অন্যতম। আখতারুজ্জামানইলিয়াস বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত কথা সাহিত্যিক। তাঁর গল্পগ্রন্থেরসংখ্যা চারঃ ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’, ‘খোঁয়ারি’, ‘দুধেভাতে উৎপাত’ এবং ‘দোজখেরওম’। উপন্যাসের নাম ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াব নামা’। আন্ওয়ার আহমদ কবিএবং ছোটগল্প লেখক এবং সর্বোপরি একজন সম্পদক। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোহচ্ছে-রিলকের গোলাপ, মানবসম্মত বিরোধ, নির্মাণে আছি, হঠাৎচলে যাবো, শেষসম্বল শেষ দান, অঙ্গ তোমার কাব্য করে, নীল কষ্টের ডাক, প্রেম পদাবলী, উনষাটের পদাবলী, ষাটের প্রামত্ম ছুঁয়ে, অটর থাকা ধীর সন্যাস, উড়ো খইগোবিন্দ নমঃ। গল্পগ্রন্থ-অন্ধকারের সীমানা, আন্ওয়ার আহমদের গল্প, অন্ধকার, সতর্ক প্রহরা ও অন্যান্য গল্প। সম্পাদিত গ্রন্থ-পঞ্চশর, আজকের কবিতা, সিলেক্টেড পয়েমস অব আবদুল মান্নান সৈয়দ, একজন কবি দিলওয়ার, কবি আতাউররহমান, একজন কবি আহমদ রফিক, একজন গল্পকার (আবদুল মান্নান সৈয়দ)। তিনিসুদীর্ঘ ৩৮ বছর যাবৎকবিতা পত্রিকা ‘কিছুধ্বনি’, গল্প পত্রিকা ‘রূপম’ সম্পাদনা করেছেন এবং মৃত্যুঅবধি সম্পাদনা করেছেন। তাঁর রূপম প্রকাশনী থেকেশতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে এদেশের অসংখ্য তরুণের প্রথম বইতাঁর রূপম প্রকাশনী প্রকাশ করেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৯৪-এর জানুয়ারিএবং আন্ওয়ার আহমদ ২০০৩ খৃস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর লোকামত্মরিত হন।

জ্যোতিপ্রকাশদত্ত বগুড়া আযিজুল হক কলেজে অধ্যয়নকালীণ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।পরবর্তীকালে ষাট দশকের একজন গল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহে নাসুবাতাস, দুর্বিনীত কাল, সিতাংশু তোর সমসত্ম কথা’ অন্যতম গল্পগ্রন্থ। এখনআমেরিকা প্রবাসী। রবি ভট্টাচার্য, শ্যামল ভট্টাচার্য ভ্রাতৃদ্বয় মূলত নাটকরচনায় পারদর্শী। রবি ভট্টাচার্যের দাইনেম ইজ, মেডেল, আলোয় খুঁজে ফেরা মঞ্চসফল নাটক, শ্যামল ভট্টাচার্য নাট্য রচনা, নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়েও সমানদক্ষ।

আলাউদ্দীনঅনেক নাটক রচনা করেছেন। বোবা কান্না, নকল মানুষ, বিষের পেয়ালা, মন্টুরপাঠশালা সুনাম অর্জন করেছে। তিনি ক্ষেতলাল থানার অধিবাসী। মৃণালকামিত্মসাহা একজন সঙ্গীতশিল্পী হলেও নাটক রচনাতেও তিনি সমান দক্ষ। নাট্য বিষয়আলোচনাও তাঁর আছে। তাঁর রচিত নাটক-‘ককটেল’।

রবিউল আলমজন্ম বারপুর, বগুড়া ১লা ১৯৪৮। নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা এবং গল্পকার।চাকরি সুবাদে ঢাকায় বসবাস করছেন। তাঁর অনেকগুলো নাটক বেতার ও টিভিতেপ্রচারিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। টেলিভিশন ও বেতারে উল্লেখযোগ্য নাটক-নাপুস, সমাপ্তি অন্য রকম, এক যে ছিল দুই হুজুর, কখনো সৈকতে, আরো একজন রাবেয়া, পরবাসী, সবুজিয়া, বিপ্রতীপ, আমি যখন বন্দী, এক সকালে, যার সাথে যার, উল্টোফাঁদ, একজন মিশার ঈদ, তোমরা আমার ইত্যাদি।

ষাটের আরো যাঁরাঃ

ষাট-এরদশকে আরো যাঁরা সাহিত্যভূমিতে পা রেখেছিলেন তাঁরা হলেন-নূর মোহাম্মদতালুকদার, মুহম্মদ রহমতুল বারী, মোসত্মফা নূরউল ইসলাম, মিনতি কুমার রায়প্রমুখ। নূর মোহাম্মদ তালুকদার ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৭ খৃস্টাব্দের শেষে দিকে‘স্বরক্ষেপ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরুকরেন।। তাঁর দু’টি কাব্যগ্রন্থ-বিবাগী কাল ও শুক্লাতিথির চিঠি।উপন্যাস-জঠরে আগুন জ্বলে। মুহম্মদ রহমতুল বারী পেশায় ডাক্তার, শেরপুরনিবাসী। তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর-স্বপ্নের সোনালী আবীর, জেগে থাকি, সুখ-দুঃখপদাবলী। একমাত্র গল্পগ্রন্থ-বিকাউ। অধ্যক্ষ মোসত্মফা নূরউল ইসলামেরএকমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম-‘আমাকে আসতে বললে না’। অধ্যাপক মিনতি কুমার রায়লিখেছেন একটি গবেষণাগ্রন্থ-সমালোচনাতত্ত্ব। ষাটের একেবারে শেষ পর্যঅয়ে আরোদু’একজন লেখকের নাম পাচ্ছি-এঁরা হলেন-আব্দুর রফিক খান, তাঁর গ্রন্থ-তবুওমানুষ (১ম ও ২য় খন্ড), তিনি কবি কে এম শমশের আলী কনিষ্ঠ ভ্রাতা, বর্তমানেআমেরিকা প্রবাসী। ফজলুল আলম-এর গ্রন্থ-সাহসিনী নারী, মনের ব্যভিচার, পরবাস, প্রশ্ন থেকে যায় ইত্যাদি। আরেকজন লেখক সালেহা চৌধুরী বর্তমানে লন্ডনেপ্রবাসী। তিনি উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়া লিখেছেন। যখন নিঃসঙ্গ, উষ্ণতর প্রপাতে, তাহিতি এবং অন্যান্য। উপন্যাস-আনন্দ, বিন্নি ধানের খই, ময়ূরীর মুখ, প্রবন্ধ-সাহিত্য প্রসঙ্গে, পরমা, প্রবাস চিমত্মা।

বগুড়ার সাহিত্যঃ সত্তর-এক দশকঃ স্বাধীনতাত্তোর আকাঙ্ক্ষা:

স্বাধীনবাংলাদেশে শুরুতেই নতুন লেখকদের আমরা পাইনি। দেশের বিপর্যসত্ম অর্থনৈতিকঅবস্থা, চারদিকে ধবংশ আর সত্মূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একদিকে স্বাধীনতা পাওয়ারআনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর হাহাকার সাহিত্যের ভুবনকে সিত্মমিত করেরেখেছিল। ১৯৭২-এ ৬ জুন আমাদের এক কাব্যসহচর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের কনিষ্ঠ অধ্যাপক ষাটের অন্যতম তরুণ কবি হুমায়ন কবির আততায়ীর গুলিতেনিহত হলেন। আগস্টে কবি ফারুক সিদ্দিকী ‘বিপ্রতীক’ কবিতাপত্রের অষ্টম সংখ্যাপ্রকাশ করেন এবং সেখানে কবি হুমায়ুন কবিরের মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করা হয়এভাবে-‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ অধ্যাপক ও তরুণ কবি বিপ্রতীকগোষ্ঠীর অন্যতম শুভানুধ্যায়ী হুমায়ুন কবিরকে ছয়ই জুন রাত্রি ন’টায়রহস্যজনকভাবে হত্যায় আমরা গভীরভাবে ব্যথিত হয়েছি, মর্মাহত হয়েছি। সব সময়সকল হত্যাকান্ড নিন্দনীয়।’

১৯৭৪-এ‘অনুকাল লেখ গোষ্ঠী’র ছায়াতলে বেশ কিছু তরুণ লেখক একত্রিত হন। সমাজ, প্রেমএবং যুদ্ধোত্তর নতুন স্বদেশ চেতনায় তাঁদের লেখালেখি এগুতে থাকে। এই দশকেযাঁরা সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তাঁরা হলেন-মনজু রহমান, রায়হান রহমান, আবদুররাজ্জাক, শোয়ের শাহরিয়ার, জি, এম হারূন, মাহমুদ হাসান, পুটু আখতা, মোসত্মফাআলী, সজীব শামত্মা হীরু, আফরুজ জাহান, সুজন হাজারী অমিয় সাহা, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ফারুক ফয়সল প্রমুখ। এদের মধ্যে অনেকে লেখালেখি থেকেসরে গেছেন, কেউ নতুন চেতনায় গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছেন।

মনজুরহমান কবিতা চর্চায় এখনও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ‘জলের নূপুর’। ‘পান্ডব’ ও ‘টাঙ’ নামে কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতআছেন। তাঁর সম্পাদনায় এই দশকে অনড়, এ্যালবাম, যুগল জানালা, নির্বাচিত কবিতাইত্যাদি প্রকাশিত হয়। রায়হান রহমান কবিতা চর্চায় নিজেকে একাগ্রভাবে নিমগ্নরেখেছিলেন। তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থ এখনও বের হয়নি। এই সময় তাঁর সম্পাদনায়অনড় এবং যুগল জানালানসহ বেশ ক’টি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। শোয়েবশাহরিয়ার তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ-শোকগুচ্ছ শ্লোক গুচ্ছ (১৯৯১), মণীষার জন্যপঙ্ক্তিমালা (ডিসেঃ ০৭) প্রত্নরোধে শরীর পোড়ে, কোরতে লদীর বুকের উসুম(বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার কবিতা)। প্রবন্ধ গ্রন্থ-আখতারুজ্জামান ও খন্ডিতচেতনার নান্দীপাঠ। তাঁর সম্পাদনায় ‘মনোসরনী’ নামে একটি চমৎকার পত্রিকাপ্রকাশ পায়। সরকার আশরাফ-সম্পাদিত ‘নিসর্গ’ পত্রিকাটির প্রকাশকও তিনি।আবদুর রাজ্জাকের একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ-কে গ্রহণ করে অসিত্মত্ব আমার। তাঁরসম্পাদনায় ‘শতবর্ষী’ পত্রিকাটির ৭টি সংখ্যা প্রকাশ পায়।

১২টিউপন্যাস ৪টি গল্পগ্রন্থ, ৮টি কবিতাগ্রন্থ, ৫টি ছড়াগ্রন্থ ও একটি সম্পাদিতগ্রন্থসহ প্রায় ৫০টি গ্রন্থের জনক জি. এম হারুন। উপন্যাস-নীল চোখে নীলযন্ত্রণা, যে ছিল মনে, তুমি আসবে বলে, যে ছিল অমত্মরে। গল্পগ্রন্থ-সরবেনীরবে, অধিবৃত্তে অাঁধার, স্মৃতি নির্ভর, চোখের আয়তনে।কাব্যগ্রন্থ-ভালাবাসা একদিন, মগ্ন রব মাটির প্রেমে, বিষ্টি নামে নামে নাইত্যাদি। ছড়াগ্রন্থ-হেই সামালো, কেচ্ছাকান্ড, এক বসত্মা ছড়া। তাঁর সম্পাদিত‘স্মৃতিতে জলপড়ে টুপটাপ’ নামে বগুড়ার কবি-লেখকদের জীবনীমূলক গ্রন্থ। তিনি‘তূণ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ‘মল্লিকা’ বগুড়া লেখক চক্রপুরস্কার পেয়েছেন। অবসর ও অাঁচল নামেও দুটো পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

খালিকুজ্জামানইলিয়াস, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়ামের অনুজ। খালিকুজ্জামানইলিয়াস গালিভারের ভ্রমণ কাহিনী, রসোমন, মিখাইল সলোকভের প্রথম জীবনের গল্প, মিথ্যের শক্তি নামে কয়েকটি গ্রন্থ প্রণেতা। তিনি ২ খন্ডে ‘আখতারুজ্জামানইলিয়াস সমগ্র’ সম্পাদনা করেছেন।

সুজনহাজারী কবি হিসেবেই উত্থান। তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ, ছড়াগ্রন্থ আছে।একজন জীবনবাদী কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তিনি জয়পুরহাটউচ্চারণরণ সাহিত্যগোষ্ঠীর অন্যতম সংগঠক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-কৃষ্ণপক্ষ সংক্রামত্ম ওভালোবেসে রাজা হবো।

অমিয়সাহা, আযিযুল হক কলেজে পড়াশুনাকালে প্রচুর কবিতা লিখতেন। তার অনেক কবিতাবিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। এই কবি পরবর্তীতে আইন ব্যবসাকে পেশাহিসেবে নিয়েছিলেন। এই কবি আকস্মিকভাবে পরলোকগমন করেন।

শহীদঅধ্যাপক মোহসিন আলী দেওয়ানের জ্যেষ্ঠপুত্র ফারুক ফয়সল ছোটবেলা থেকেই পিতারঅনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেন। পেশা বেছে দেন সাংবাদিকতা। ছোটগল্প ওউপন্যাস তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। উপন্যাস-তার নীল চোখ এবং প্রবন্ধ-রাজধানীররাজনীতি। দীর্ঘকাল কানাডায় প্রবাস জীবন শেষে এখন দেশে অবস্থান করছে। পুটুআখতা এ সময়ের এক তরুণ লেখক। নাটক ও ছোটগল্প লেখক। নাটক-বিভ্রাট, আমি কে, স্বয়ং ভূত ইত্যাদি তাঁর নাটক। বিশেষ রচনা ‘বগুড়ার নবাববাড়ীর, সেকাল-একাল ওএকজন মুক্তিযোদ্ধার ডায়রি থেকে।

মোসত্মফাআলী, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন বেশ ক’টি। মানিক চেতনাঃ ভিন্ন প্রেক্ষিত, মানিক ও জীবনান্দ, নৈঃশব্দের কোলাহল, হেনরিক ইবসেন ও তাঁর শিল্পচেতনা, উপন্যাস-‘নীলকন্ঠ পাখি’ গল্প সংকলন-সময়ের শেষ প্রহর, কাব্যগ্রন্থ-প্রত্নহৃদয়ের জ্বালা (যৌথ)।

বগুড়ার সাহিত্যঃ আশির দশকঃ উজ্জ্বল তারুণ্য:

আশির দশকেএক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ লেখকের সাহিত্য অঙ্গনে সদম্ভ পদাপাত আমাদের আশান্বিতকরলো। এই সময়ে যাঁরা এসেছেন তাঁরা হলেন-শেখ ফিরোজ আহমদ, আশীস-উর-রহমানশুভ, আজিজার রহমান তাজ, সুকুমার দাস, প্রদীপ মিত্র, পলাশ খন্দকার, ফখরুলআহসান, জয়মত্ম দেব, শিবলী মোকতাদির, বিদ্যুৎসরকার, আব্দুল্লাহ ইকবাল, মাহমুদ হোসেন পিন্টু, পিয়াল খন্ডদার, রোহন রহমান, সৈয়দ মাহবুব, পান্নাকরিম, হাবীবুল্লাহ জুয়েল, শের আফগান শেরা, ড্যারিন পারভেজ, মিঠু হোসেন, খন্দকার আমিনুল করিম দুলাল, খন্দকার রেজাউল করিম হীরু, আশিক সারওয়অর, গাজীসারোয়ার, খাদিজা এলমিস, আব্দুর রউফ খান, খন্দকার বজলুর রহিম, সারোয়ার হোসেনবিকাশ, বায়েজীদ মাহবুব, আরিফ রেহমান, সুপান্থ মল্লিক, মনসুর রহমান, আব্দুররশিদ, আব্দুর রহিম বগরা, আব্দুস সামাদ, মতিউল ইসলাম, ফেরদৌসুর রহমান রিটা, তৌফিক হাসান ময়না, ফরিদুর রহমান, রোকেয়া মাহবুব, রেজাউল করিম মুন্টু, সরকার সাইফুল মাহমুদ, নবী নাজমূল হক তালুকদার, (ন, না, হক তালুদকার), তাঁরসম্পাদিত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘ভোর হলো দোর খোল’।

প্রদীপমিত্রের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-পতাকার অহংকার (১৯৯৯), দেখি সেই দগ্ধগ্রাম(২০০১), তার হাতে দীর্ঘ এক হাত (২০০২), আকাশের সুবিসত্মার (২০০৩), অগ্নিতঅঙ্গার (২০০৪) ও জনতার সিংহ নাম (২০০৬)।

শেখ ফিরোজআহমদের জন্ম চাঁদপুরে কিন্তু অধ্যাপক পিতার বদলীসূত্রে তিনি আশির দশকেবগুড়াতে স্থায়ীভাবে অবস্থানের সময়ে বগুড়ার সাহিত্য জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেজড়িয়ে পড়েন। ষাট ও সত্তর দশকের লেখকদের সঙ্গে তিনি সু-সম্পক গড়ে তুলতেসমর্থ হন। ছাত্রাবস্থাতেই প্রচুর লেখালেখি এবং পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাতকীর ছায়া’ প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি রক্তারুণ, চত্বর, ঈক্ষণ নামে লিটন ম্যাগাজিনেরপ্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ‘বগুড়া লেখক চক্র’ প্রতিষ্ঠা ও এই সংগঠনকে এগিয়েনেওয়ার পিছনে শেখ ফিরোজ আহমদের অবদান সবচেয়ে বেশি।

সাজাহানসাকিদার একজন প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার ও ভিন্নমাত্রার ঔপন্যাসিক। তাঁরপ্রকাশিত বই-উপন্যাসঃ শ্মশানযাত্রীর নরক উল্লাস-১৯৯৫, বত্রিশ বিঘা ধানীজমি-২০০০, স্বপ্ন বিক্রেতাদের গল্প-২০০৭, আবারও জেগে উঠবে এই ডুবোচর-২০০৭, গল্পগ্রন্থঃ পাতালে এক বর্গ-২০০৪, উল্টোরথ-২০০৫, বলি ও অন্যান্য তীরেরসমীকরণ-২০০৮।

ফখরুলআহসান এক তরুণ কবিতাকর্মী। কোনো কবিতাগ্রন্থ বেরোয়নি, তবে প্রকাশ অপেক্ষায়আছে। সম্পাদনা করেছেন ‘মর্মর’ এবং ‘পথ’ কবিতা পত্রিকা। পান্না করিমেরএকমাত্র কাব্যগ্রন্থঃ আকরিক সুখ-দুঃখের জার্নাল। জয়মত্ম দেব কবিতায় নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ-‘করতোয়ার জল ছুঁয়ে বেড়ে ওঠে বেহুলার ছেলে’।‘দ্যুতি’ নমে একটি পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে।

পিয়ালখন্দকার ছোটগল্প এবং উপন্যাসই বেশি লিখেছেন। তাঁর ছয়টি উপন্যাস-শুধুতোমাকেই ভালবাসি, প্রেম তুমি তোমাকে, ভালবাসার তিন রং, ফিরে এসো হৃদয়েআমার, ধন্যবাদ, হে ভালবাসা, শ্রাবণে তোমাকে চাই। গল্পগ্রন্থ-প্রেম ওস্বপ্নের পাখিরা।

আব্দুল্লাহইকবালের একটি কাব্যগ্রন্থ-গোল গোল রাত। সম্পাদনা করেছেন- মাইলস্টোন, অতিক্রম, নোয়াজার্ক। মাহমুদ হোসেন পিন্টুর কাব্যগ্রন্থ-কেউ নেয় না গোলাপ, এসো একাকীত্বের অরণ্যে। উপন্যাস-কষ্ট বিলা। সম্প্রতি একটি প্রবন্ধের বইবেরিয়েছে।

আজিজাররহমান তাজ আশির দশকে বগুড়ার সাহিত্য জগতে যার সরব পদচারণা। লেখালেখির বিষয়‘আশয় গদ্য, কবিতা, ছড়া। এসব মিলিয়ে তার প্রকাশনা গ্রন্থের সংখ্যা সাত।মল্লিাকা সাহিত্য পত্রিকা ২১ বছর ধরে প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন। মল্লিকা’রপ্রকাশনা সংখ্যা ৩৬টি। ছড়ায় তার হাত খোলে চমৎকার। ‘জননেত্রীর প্রতিকৃতি’ ও‘আমাদের হুমায়ুন আহমেদ’ নাম দু’টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। তাঁর কবিতারবই-ইস্যু সংকট, কবিতা কার্ডঃ ‘ভালোবাসা সোনার হরিণ’, ‘ভালোবাসা বুকেরবকুল’। তাঁর কাব্যগ্রন্থ অরণ্যের ভেতরে পা, বিষাক্ত ফুলের মধু, জননী আমারঅহঙ্কার। গল্প গ্রন্থঃ ঐকতান, গল্পমঞ্জরী।

অকালপ্রয়াতখন্দকার আমিনুল করিম দুলাল। বগুড়া কারূপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা। মূলতকারুশিল্পী ও শিল্পকর্মের ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন ছড়া, নাটক, কবিতা। অতৃপ্তঅন্ধকার, অথচ চলছে, স্বয়ং ভূত, তাঁর রচিত মঞ্চসফল নাটক। বগুড়াসহ বাংলাদেশেরঅনেক লেখকের প্রচ্ছদ তিনি করেছেন। শিল্পকর্মের জন্য তিনি ভারতের অশোকাফেলোশিপ লাভ করেন। খাদিজা এলমিস। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে-এইফুলবন, অন্য জনম। খন্দকার বজলুর রহিম কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচনায়সিদ্ধহসত্ম। শিশু সাহিত্যে তাঁর বেশ দখল আছে। কাব্যগ্রন্থ-হৃদয়ের কাছাকছি, আজো ভালবাসি গল্পগ্রন্থ, প্রিয় বান্ধবী। উপন্যাস-হৃদয়ের স্পন্দন, ইডিয়েট, ইয়েস ম্যাডাম, একটু ছুঁয়ে দেখি। ছোটদের বই-কুমারীরের রাজা, ভূতের বাড়ি।

সুকামারদাস সাহিত্য নিবেদিত প্রাণ মানুষ। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে লেখা তার লেখা। আশিরদশকে তার লেখা নাটক মঞ্চস্থ হত শহরতলী ও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে। তার দর্শকনন্দিত নাটক-‘আবার ফিরে গেলাম’ কে বড় চোর, জরিনার পেটে কার পোলা, কারকান্না, বিচারের বাণী ইত্যাদি মঞ্চ সফল নাটক। তার নাটক ‘আবার ফিরে গেলাম, ৩৬ বার মঞ্চস্থ হয়। তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘রক্তিম সূর্য’ ১১ সংখ্যাপ্রকাশিত হয়। তার কবিতা গ্রন্থ ‘বুভুক্ষ মানুষের মিছিল’ প্রকাশের অপেক্ষায়।এ ছাড়াও জনকন্ঠ ও ভোরের কাজগে তার সাম্প্রতিক রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্নসমস্যার সমাধান আলোকে লেখা প্রায়শঃ প্রকাশিত হয়ে থাকে। তিনি প্রতিবাদীকবিতা লেখায় সিদ্ধহসত্ম।

গাজীসারোয়ার কবিতা, গল্প রচনা করেন। ‘বৈশাখী মেলা’ নামে একটি কাব্য সংকলনসম্পাদন করেছেন। তিনি বগুড়া লেখক সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।‘লেখক’ নামে পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে। আব্দুস সামাদ মূলতঔপন্যাসিক। তাঁন তিনটি উপন্যাস-মেঘে ঢাকা শশী, মেঘে ঢাকা রবি এবং প্রকাশকেরমৃত্যু। তাঁর ইংরেজিতে একটি কাব্যপুসিত্মকা প্রকাশ পেয়েছে-‘টু পোয়েমস টুবিল ক্লিনটন’। হাবীবুল্লাহ জয়েল-এর কাব্যগ্রন্থ-এঞ্জেলিক ভয়েস, মহাপ্রলয়, ফতোয়া, রক্তাক্ত ইতিহাস বগুড়ার নওয়াব বাড়ির ইতিহাস, হযরত শাহ ফতেহ আলী(রঃ), জিয়াউর রহমানঃ জীবন থেকে নেওয়া। ফেরদৌসুর রহমান রিটার একটি মাত্রকবিতাগ্রন্থ-‘লাল চিঠি’। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আকস্মিক তিরোধানকাব্যাঙ্গনের জন্য সত্যিই শোকাবহ ঘটনা। আব্দুর রশীদ। তাঁর তিনটিকাব্যগ্রন্থ-রূপসী প্রামত্মর, আকাশ গ্রামের পাখি, বর্ষার দেহে কাব্যেরআগুন। তিনি পুন্ড্রতোয়া’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তৌফিক হাসানময়না মূলত সংগঠক ও নাট্যকার। তিনি বগুড়া থিয়েটারের প্রধান সংগঠক। অভিনেতা, নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। তার নাটক-যে গল্পেরশেষ নেই, যুদ্ধ স্বাধীনতা, সোনাভানের পালা, হল্লাবোল, স্বাধীনতা কাঁদে আজো।তাঁর রচিত নাটক টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত হয়েছে। আশির দশকে অন্যান্যরাএখনও বই প্রকাশ করেননি। তাঁরা লিখছেন, কেউ কেউ লেখার জগৎথেকে দূরে সরেগেছেন। এসময় শেরপুর সাহিত্য চক্রের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে বেশ কিছু লেখকেরউত্থান ঘটে। এদের মধ্যে আজিজুল হক, সুব্রত ঠাকুর, দীপংকর চক্রবর্তী, কাজলদত্ত, সদানন্দ লাহিড়ী, আব্দুর রউফ, গৌতম সরকার প্রমুখ।

বগুড়ার সাহিত্যঃ নববই ও শূন্য দশকঃ নব যাত্রাপথ

নববই-দশকএই দশকেই সাহিত্য পথযাত্রায় এক নতুন চেতনা আমাদের বুদ্ধিবিভায় তুলেছে ঝড়োহাওয়ার মাতম। যে প্রক্রিয়ায় আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব পূর্ণ জঙ্গমতা নিয়েঅগ্রসর ছিল, সেখানে বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে এই নতুন সাহিত্যতত্ত্বএযাবতকালের ধ্যান-ধারণায় অভিঘাত সৃষ্টি করলো, যার সূচনা ষাট-সত্তর দশকে। এইনতুন সাহিত্যতত্ত্বে অভিমুখীন যাত্রায় ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, মনোসমীক্ষা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, নারীবাদীতত্ত্ব, শৈলীবিজ্ঞান একাকার হতে চায়-এসবেরই একটি উল্লেখযোগ্য নামকরণ ‘উত্তরআধুনিকতা’ যা বলা বার্থের সাহিত্য সমালোচনা, আলথুসারের মার্কসের রচনাপাঠ, লেভি স্ট্রুসের নৃতত্ত্ব, মিখাইল বাখতিনের উপন্যাসতত্ত্ব, জাঁক দেরিদারবিনির্মাণের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করেছে। এসবেরই ধারাবাহিকতা রাজধানী ঢাকাসহ সবজেলাতেই উত্তর আধুনিকতার তথ্য তালাশ চলছে কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে।বগুড়াতে বেশ কিছু লেখা উত্তর আধুনিকতার তত্ত্বে পুষ্ট হয়ে সে-ধারণা থেকেলিখছেন, কেউ কেউ প্রথাগত সাহিত্যে আশ্রয় নিয়েছেন। নববই দশকের কম্পমান তরুণলেখকদের মধ্যে শামীম কবীর, আপলু, জামরুজ্জামান মাসুম, মামুন রশীদ, অমিতরেজা চৌধুরী, আবু রায়হান চঞ্চল, লিটন সাহা, টটুল রহমান, নীলুফার নাসিরনীলা, শাহন-ই-জেসমিন ডরোথী, মতলেবুর রহমান, সায়রা হেলাল, এস, এম, শাজাহান, মহল আরা, হিমেল সরকার, সাইফুল ইসলাম, সিরাজুল হক মন্টু, মোহসিম বিল্লাহসবুজ, সেলিম রেজা সেন্টু, স্বাতী রহমান, মুমিনুর স্বপন, অরবিন্দ দাস, নূরুন্নবী খান জুয়েল, সাহাব উদ্দিন হিজল, কামরুল নাহার, রায়হান রানা, কাজলআহমদে খৈয়াম কাদের, সাজ্জাদ বিপ্লব, রহমান তাওহীদ প্রমুখ। এদের মধ্যেঅনেকেই কমবেশি লেখার জগতে বিচরণ করছেন। খৈয়াম কাদেরের কাব্যগ্রন্থ ‘পারদবিশ্বাস’ প্রবন্ধ, কবিতার এষন-ভূষন। তার সম্পাদিত পেশায় ইংরেজি সাহিত্যেরশিক্ষক।

তরুণ কবিশামী কবীর নীরিক্ষামূলক কবিতা রচনায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরপ্রকাশিত হয়েছে ‘শামীম কবীর কবিতা সমগ্র’। আপলু লিখেছেন একজন, তবুও তুমিআমার, সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে, ও একটি যৌথ কবিতার বই’ সেই তুমি এবং একটিকবিতার কার্ড ‘তোমাকে স্পর্শ করবো বলে। কামরুজ্জামান মাসুমের যুগল সংলাপ, নীলুফার নাসির নীলার গল্পগ্রন্থ-আপন বলয়, মহল আরার উপন্যাস-সুখের সন্ধানে, স্বাতী রহমানের গ্রন্থ-বিউগিল বনভূমি, গল্পমঞ্জুরী এ সময়ের উল্লেখযোগ্যরচনা। অন্যরা এখনো লিখে যাচ্ছেন, সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল লেখকগণ আগামীদিনে বগুড়ার সাহিত্যাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন এ আশাবাদ ব্যক্ত করাযায়। নববই দশক সম্পর্কে এখনই চরম মমত্মব্য করা উচিত নয় বলে মনে করি। তবেসাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র তৈরিতে তারা সচেষ্ট আছেন। তিরিশের পরেষাটে যেমন ছিল চমকে দেবার প্রবণতা, সাহিত্যের পরীক্ষা নিরীক্ষায় এগিয়েযাওয়ার উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা, অনুরূপ সত্তর আশি পেরিয়ে নববই-শূন্য দশক আমাদেরসাহিত্যের বিলোড়নের দশক বলে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

শতাব্দীরপ্রথম দশক হিসেবে ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে সাতটি বছর। বগুড়ার তরুণরাও তাদেরঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। এসময়ে যারা উজ্জ্বল পদাচারণায় মুখরকুরে তুলেছেন সাহিত্যের অঙ্গন তাঁরা হলেন-অনমত্ম সুজন, এমরান কবির, মাহমুদশাওন, ইসলাম রফিক, তালাশ তালুকদার, সরফরাজ স্বয়ম, প্রামিত্মক অরণ্য, কামরুননাহার-এর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘খোলা আকাশ (২০০৩), জল রঙের স্বপ্ন (২০০৩) দুটিউপন্যাস। আরো লিখছেন হান্নান সৈকত, শাহাজ শাহী, অজমত্মা শ্রাবণী, রুবীরুমানা, ইশান সামী, বিধান সাহা, আমিনুর রহমান আকাশ, সৌম্য সজীব অনিন্দআউয়াল, ফাল্গুনী রহমান সেলিনা শিউলি, মিতানূর, তাসলিমা পারভীন বিউটি, সাকিলআহাম্মেদ ফৌজিয়া। মুহম্মদ আব্দুর রশিদ তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ ঝরাপাতারকান্না (২০০৫), নদীর ঘাট দেখেছি (২০০৬), স্বপ্নচারী (২০০৬)। সায়রা হেলাল-এরউপন্যাস-হৃদয় জুড়ে তুমি, কষ্টে ভেজা উপহার, অগ্নিক্ষরা বসমত্মঃ সাহাবউদ্দিন হিজল-এর উপন্যাস-মেঘ ভাঙ্গা রোদ, নয়না। গল্পগ্রন্থ-‘নতুন পথে’, ছোটদের গল্প-ইচ্ছে পুরণ। কাজী রাফি-কাব্যগ্রন্থ সুতীক্ষা’০৩, ঝিঁ ঝিঁ ডাকাএক রাতে’০৬, গল্পগ্রন্থঃ রূপডাঙ্গার সন্ধানে’০৭, উপন্যাসঃ নিসর্গেনিরুদ্ধ’০৭ প্রকাশিত।

শূন্যদশকের তরুণেরা পূর্ববর্তী দশকের অভিজ্ঞতা ও অর্জন ধারণ করে এবং বিশেষপ্রস্ত্ততি নিয়েই এসেছে। তাঁদের চেতনা ও রুচির প্রকাশ সে-কথাই বলে। এ দশকেরতরুণেরা কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে, গদ্যে, সম্পাদনায় অনেক বেশি পরিশীলিত।ইতোমধ্যেই বেরিয়েছে মাহমুদ শাওনের ছড়াগ্রন্থ ‘টাপুর টুপুর মেঘের দুপুর’।তিনি ‘সুতরাং’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেন। ইসলাম রফিকেরকাব্যগ্রন্থ ‘বিজন দ্বীপে বিশ্বাসী বালি হাঁস। সে দোঅাঁশ নামে একটিম্যাগানিজ সম্পাদনা করেন ‘মিতানূরের কাব্যগ্রন্থঃ পাথর হৃদয় (২০০৩), শ্রাবণের অশ্রু বিন্দু, নির্বাচিত কবিতা, দুঃখগুলো তো দূরেই ছিল, গল্পগ্রন্থঃ সুখ দুঃখ, পাথরের চোখে জল (২০০৫), প্রবন্ধ গ্রন্থঃ আকাশে অনেকমেঘ (২০০৪) ইত্যাদি। তাসলিমা পারভীন বিউটি’র কাব্যগ্রন্থঃ অন্য রকম প্রেম, (২০০৭), সাকিল আহাম্মেদের-একটু কাছে একটু দূরে (২০০৭), ফৌজিয়ার উপন্যাস-একফোঁটা ভালবাসার জন্য, পেলাম অবশেষে। আরো কিছু তরুণের গ্রন্থ বইমেলায়প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছেন এ দশকের তরুণেরা। তারা হলেন-অনমত্ম সুজন, এমরানকবির, মাহমুদ শাওন। অনমত্ম সুজনের সম্পাদনায় ‘সুবিল’ এবং এমরান কবিরেরসম্পাদনায় বের হয় ‘থার্ডম্যাগ’ যা ভিন্নমাত্রিক ছোট কাগজ হিসেবে প্রতিষ্ঠাপেয়েছে।

বগুড়ার সঙ্গীত জগ:

১। বৈদ্যনাথ দত্ত ৫০ দশক

২। শিবেন কুন্ডু ’’

৩। শৈলেন পোদ্দার ২৭/৩ সত্মব্দ আলাউদ্দিন সরকার (৫০ দশক)

৪। তারাপদ ব্যানার্জী ’’

৫। অনিল বিশ্বাস ৬০ দশক

৬। রামগোপাল মহন্ত ’’

৭। এমদাদুল হক ’’

৮। মোস্তফা নুরউল মোহসিন ’’

৯। জাহানারা লাইজু ’’

১০। হোসনে আরা ’’

১১। আঞ্জুমান আরা বেগম ’’

১২। জিনাত রেহানা ’’

১৩। সাইফুল ইসলাম ’’

১৪। শামন্ত সেনগুপ্ত ’’

১৫। শামসুন্নাহার ’’

১৬। নিজামূল হক (নৃত্য) ’’

১৭। অর্জুন কুমার মোহমন্ত ’’ (বেহালা বাদক)

১৮। মমতাজ উদ্দিন ’’ (বাঁশী)

১৯। সারদাকিঙ্কা মজুমদার ’’ (তবলা)

২০। রফিকুল আলম দুলু ’’ (বাঁশী)

২১। আজমল হুদা মিঠু ’’

২২। কামরুল হুদা টুটু ’’

২৩। খন্দকার ফারুক আহমদ ’’

২৪। শওকত হায়াত খান ’’

২৫। অনুপ ভট্টাচার্য ’’

২৬। মৃণাল কান্তি সাহা ’’

২৭। ওস্তাদ খাজা গোলাম মইনুদ্দিন ৭০ দশক

২৮। সুইটি খান ’’

২৯। ছায়া কুন্ডু ’’

৩০। স্বপন কুন্ডু ’’

৩১। গুরুদাস পোদ্দার ’’

৩২। তৌফিকুল আলম টিপু ’’

৩৩। শেখ নুরুল আলম লাল ’’

৩৪। হেলাল উদ্দিন ’’

৩৫। মুস্তারি জাহান ’’

৩৬। নুরুল ইসলাম ৮০ দশক

৩৭। শাহানাজ পারভীন ’’

৩৮। এনামূল হক ’’

৩৯। স্বপন সিংহ ’’

৪০। আব্দুল আউয়াল ৯০ দশক

৪১। জিনিয়া জাফরিন লুইপা ’’

বগুড়ার শিল্পীবৃন্দ (চিত্রশিল্পী):

কাজীআব্দুর রউফ, আমিনুর রহমান, সুলতানুল ইসলাম, জাহিদ হোসেন, নিয়ামুল আরিফ, স.ম. বক্তিয়ার, মনিরুল ইসলাম নান্টু, হেলেনা খানম ইরানী, আমিনুল করিমদুলাল, মযহারুল করিম নীরু, এমদাদুল হক (ঘেরা বকুল), প্রভাত সরকার কাঞ্চু।

ছোটকাগজগুলো হচ্ছে-বিপ্রতীক, দ্রষ্টব্য, ঈক্ষণ, পদধ্বনি, স্বরক্ষেপ, অবেলা, অপরাহ্ন, প্রাচী, অধোরেখ, নতুন দিন, রক্তশব্দ, অকেস্ট্রা, অনড়, এ্যালবান, শব্দাবলী, অনুকাল, সারাক্ষণ, আত্মপ্রকাশ, যুগল জানালা, ঝুলন, চিত্রক, সোমবার, শতবর্ষী, রক্তারুণ, অমত্মরঙ্গ, বিতর্ক, চেতনা, সিস্ফনী এবং প্রেম, চোখ, চিরকুট, শাদাশার্ট, যন্ত্রণা, নানান, একতারা, সন্ধ্যাতারা, শরনীসূর্যতোরণ স্ফুলিঙ্গ, শাশ্বাত বাংলা, প্রেক্ষিত, দ্যুতি, তূণ, পথ, ভোর হলোদোর খোল, মল্লিকা, কবি, তুমি, রক্তিম, সূর্য, নিসর্গ, স্পর্ধা, তর্জন, সচেতন, সাধ, সুতরাং, অবয়ব, প্রতীতী, উদ্যান, পরমা, জলছাপ, দীঘি, লেখক, কাকতাড়ুয়া, অতিক্রম, নোয়াজার্ক, ডামি, এডিশন, প্রতিকাগজ, থার্ডম্যাগ, সুবিল, পরিধি, দ্বিবাচ্য, দেউড়ি, পুন্ড্র, পুন্ড্রতোয়া, বাতিঘর, খোলাদশক, ধনুক, দোঅাঁশ। এছাড়াও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিকগুলোর সাহিত্যপাতাসাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

 

 

সূত্রঃ জেলা ওয়েব পোর্টাল